• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

ছুটির ফাঁকে

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-৩)

অজিত কুমার দত্ত

 প্রকাশিত: ০৩:৩২, ১৯ জুলাই ২০১৮

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-৩)

এখন দু'টি নাম আমাদের মুখস্থ। একজন ড্রাইভার, নাম ডেভিড। মাদ্রাজের ছেলে। বয়স পচিশের কাছাকাছি হবে। গায়ের রং কালো হলেও মুখে হাসি লেগেই আছে। এখানে ডেভিড আমাদের গাইড। দিনের অধিকাংশ সময়ই গাড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গী ডেভিড। আর এক জন সত্যজিৎ। মেদিনীপুরের ছেলে সত্যজিত ডেভিডের সমবয়সি হবে। হালকা-পাতলা গড়ন। আন্দামানে ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরির সুবাদে আছে অনেকদিন।

কার্বন কেভ থেকে ফেরার পথে চলন্ত অবস্থাতেই ড্রাইভারের হাতে সেলুলার জেলের এন্ট্রি টিকিট দিয়েছিল এই সত্যজিৎ। ওর দায়িত্ব হলো প্যাকেজ অনুযায়ী পর্যটকদের সব ব্যবস্থা করা। সারাদিন ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় যখন আমরা রুমে ফিরতাম তখন শুধু দেখা মিলতো সত্যজিতের। আর তখনই পরদিনের কি কি প্রোগ্রাম তা আমাদের জানিয়ে দিতো।

আমরা ১৮ই নভেম্বর যেদিন আন্দামানে পৌঁছেছিলাম, এর পরদিন পোর্ট ব্লেয়ারেই সারাদিনের প্রোগ্রাম। সকালে আবার সেলুলার জেল দেখতে গেলাম। সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন, বন্দিদের কি কষ্টকর অবস্থায় থাকতে হতো তা দেখলে প্রাণ কেঁদে উঠে। চট দিয়ে তৈরী পোশাক, সেই তেলের ঘানি, কিভাবে লিনচিং করা হতো তা অবর্ননীয়। রক্ত ঝরতো কিন্তু অত্যাচারের বিরাম নেই। এই ছিল ব্রিটিশ শাসকের নির্যাতনে কৌশল। বিপ্লবীদের জবানবন্দি আদায়ের জন্যই এই নির্যাতন। বড় বড় হলগুলোতে মিউজিয়ামের মত সব স্বাধীনতা যুদ্ধাদের নামের তালিকা। কে কোন রাজ্য থেকে এসেছে তার বিবরণ। বাঙালি বন্দিদের সংখ্যাই বেশী মনে হলো। কার কতদিন জেল হয়েছিল, কবে মুক্তি পেয়েছিল তার বিবরণ।

সে সব দেখার পর পুরু জেলখানা ঘুরে দেখলাম আমরা। কি ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরী। এক সেলের সঙ্গে অন্য সেলের যোগাযোগের কোন উপায়ই নেই। খুবই মোটা রড দিয়ে গারদের দরজা এমন ভাবে আটকাবার ব্যবস্থা যেন শত চেষ্টা করেও কোন বন্দী পালতে না পারে। ফাঁসি ঘরটাও দেখলাম। গা-ছমছম ব্যাপার। জেলখানার নির্মাণ কৌশল এমন ভাবেই করা হয়েছিল যে, যেন এক ওয়ার্ডের এমন কি সেলের বন্দি অন্য ওয়ার্ড বা সেলের কোন বন্দির সঙ্গে কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে না পারে। বিল্ডিংয়ের আকৃতি স্টার বা তারকার মতো। আর তৃতিয় তলার ঠিক মাঝখানে নিজ কক্ষে বসে জেলার সারা জেলের উপর নজর রাখতো।

তৃতীয় তলায় জেলারের কক্ষে উঠে আমরা অবাক হয়ে গেলাম! কি অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য, ভাবা যায়না! পিছনে অল্প দূরে সাগর। সাগরের নীলাভ জলরাশির পরেই রয়েছে সবুজ পাহাড়। ছবি তোলতে কোন বাঁধা নেই। তাই আমরা খুশিমতো ছবি তুলেছিলাম। জেলের ও ছাদের মনোরম দৃশ্যাবলীর। মন ভোলানো দৃশ্য। আর আসা না-ও হতে পারে ভেবে আফসোস থাকলো।

বর্তমানে জেলখানার পেছনের দিকের কয়েকটা উইংস ভেঙে প্রাথমিক হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষে বিনা পয়সায় চিকিৎসা পেয়ে থাকে।

ড্রাইভারের ডাকে মধ্যাহ্নভোজের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে ফিরতে হলো।

খাওয়ার পর্ব শেষে হোটেলেই আধঘন্টা বিশ্রাম। তারপর আবার শুরু। এবার গেলাম মেরিন মিউজিয়ামে। খুবই সুন্দর। তারপর এনথ্রপলজিক্যাল মিউজিয়াম। আন্দামানের উপজাতিদের ব্যবহৃত নানান জিনিষপত্র। বিশেষতঃ জারোয়াদের ছবি, কাঠের নৌকা, বর্শা, তীর-ধনুক, পোশাক-পরিচ্ছদ। দেখলাম ফিসারিজ একুরিয়াম। এটি এককথায় অসাধারণ। এই মিউজিয়ামটি মেরিনা বীচের কাছাকাছি হওয়ায় একাধিকবার যাওয়া হয়েছে। ঘুরতে বেরোলে সময় যে কি করে পালিয়ে যায় উপলব্ধি করা মুশকিল। টুরিজম কোম্পানির সিডিউল শেষ আজকের মতো। এবার আমাদের সিডিউল।

ডেভিট কে বললাম, ভাই আমাদের পাশের বাড়ির বিশ্বাস দা সরকারি বিক্রয় কেন্দ্র সাগরিকা'র পাশেই থাকেন। চলো ওখানে যাবো আমরা। বিশ্বাস দা পরিবার নিয়ে আন্দামানেই থাকেন। টেলিকম ডিপার্টমেন্টে চাকরি। আমরা যাওয়ার খবরে দেখা করতে এসেছিলেন। যাওয়ার সময় তাদের ওখানে যেতে বলেছিলেন। 'ঠিক হ্যায় স্যার। হ্যাম উতার দেঙ্গা, আপকো বাতচিত খতম হোনেছে মুঝে ফোন কিজিয়ে! হাম চলে আয়োঙ্গে। আপকো তো হোটেলমে খানেকে লিয়ে জানাই পরেগা! হাম আ যায়েঙ্গে।' বললো ডেভিড

বিশ্বাস দা'র ওখানে গিয়ে হাজির। উনারও বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাশের বাড়ির লোকজন পেয়ে দারুণ খুশি। এর মধ্যেই ঝমঝম করে হঠাৎ বৃষ্টি ! অথচ একটু আগেই রোদের কি ঝাঁঝালো তাপ ছিল। বিশ্বাস দা বললেন, এই ধরুন ১০ মিনিট, তারপর থাকবেনা। এখানকার বৃষ্টি এরকমই। ঠিক তাই অল্প সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি শেষ। দারুণ জমে গেল চায়ের আড্ডা। আন্দামানের অনেক গল্প, জাড়োয়ার গল্প, নিকোবর গল্প সব শোনলাম আমরা। গল্প হলো আর কোন কোন দ্বীপে কোন কোন স্পটে ওরা আমাদের নিয়ে যাবে তা নিয়ে। ড্রাইভার মানে ডেভিড ঠিক সময়েই গাড়ী নিয়ে হাজির। বিদায় নিয়ে হোটেলে আহার সেরে রুমের ঢুকলাম। বেশ মজা নিয়েই কাটল আমাদের ভ্রমনের দ্বিতীয় দিন। চলবে...

মন্তব্য করুন: