• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

ফিচার

মোমেনসিং পরগনায় ইসলাম প্রচার, গৌরীপুরের হিম্মতনগরে এক ওলির মাজার

রায়হান উদ্দিন সরকার

 প্রকাশিত: ০৯:২০, ১৯ আগস্ট ২০২০

মোমেনসিং পরগনায় ইসলাম প্রচার, গৌরীপুরের হিম্মতনগরে এক ওলির মাজার

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ): ময়মনিসংহের গৌরীপুর উপেজলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে হিম্মতনগর গ্রামে অবস্থিত কয়েক শত বছরের পুরনো শায়েস্তা মোড়লের মাজার। 

ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়।

জরিপে মুসলিম আমল থেকে শুরু করে সুলতান, বারো ভূইয়া, মোগল, নবাব জমিদার আমলের মসজিদ, মন্দির, মাজার, কবর, পুকুর ইন্দারা, প্রাচীন প্রসিদ্ধ স্থান, শতবর্ষী গাছ, পূর্বের নদী-নালা, গজার মাছ, মাটির নীচে এবং জঙ্গলে চিকন বা ছোট ছোট ইটের ইমারতের সন্ধান পাওয়া যায়। 

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="462" src="//www.youtube.com/embed/T1ipfxoMLow" width="725"></iframe>

এমনকি বারো ভূইয়ার শাসন আমলে সমগ্র মোমেনসিং পরগনার একটি জলদুর্গের পরিখা বা প্রাকৃতিক সীমারেখার সন্ধান পাওয়া যায়। এই জলদুর্গ দ্বারাই জলদস্যু এবং মোগল আগ্রাসন প্রতিহত করা সম্ভব হতো। 

মোমেনসিং পরগনায় ষাট এর অধিক মোগল আমলের মসজিদ ছিল যা মুসলিম শাসন এবং আফগান সামরিক প্রশাসন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগনার রাজধানী।

এই জরিপের অগ্রপথিক ও পরিচালক মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার বলেন, ইতোমধ্যে মোমেনসিং পরগনার গৌরীপুর উপেজলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদের জরিপ সমাপ্ত হয়েছে। জরিপে গৌরীপুরে ২০টি মোগল আমলের মসজিদের তালিকা প্রকাশিত হচ্ছে যা জলদুর্গের নিদর্শন। 

এ জরিপে হিম্মতনগরের প্রাচীন মাজারের উপর শতবর্ষী বটগাছ ও মাজারের কাছে মাটি খনন করলে চিকন চিকন দালানের ইট ও মাটির তৈরী প্রাচীন জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মাজার নিয়ে আরও রয়েছে অলৌলিক ঘটনার কথা ও জনশ্রুতি।

শায়েস্তা মোড়লের মাজারের আধ্যাত্নিক কিছু তথ্য বর্ণনা করেছেন এই গ্রামের বাসিন্দা মো. নূর কাসেম।

তিনি বলেন, তার নয় পুরুষ ধরে এই মাজার প্রতিষ্ঠিত। মাজারের উপর একটা বটগাছ রয়েছে এবং এক সময়ে এ গাছ অনেক বড় ছিল। এ গাছের বয়স কেউ বলতে পারে না। গাছের ডালপালা কাটলে অনেকের অসুখ-বিসুখ হয়।

তিনি শুনেছেন, জমিদার আমলে মাজারের নিকট একটা হাতি বাধা ছিল, কিছুক্ষন থাকার পর সিকল ছিড়ে হাতিটি পালিয়ে গিয়েছিল।

মাজারে নামে দশ শতক জমি রয়েছে, যা এক সময়ে গভীর জঙ্গল ছিল। মাজারের পাশে হিন্দু বাড়ি ছিল। এক পাগল এসে মাজারের জায়গায় এক কোণা পরিষ্কার করে ছোট একটি ঘর তৈরী করে ৮/৯ বছর এখানে ছিলেন, কিন্তু তিনি বিয়ে করার পর আর টিকতে পারলেন না। পরবর্তী সময়ে পুরো জঙ্গল পরিষ্কার করে মাজারের পাশে ছোট একটি মসজিদ তৈরী করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মাজারের নিকট তার প্রতিবেশী দাদীর কবরের জন্য মাটি খনন করার সময়ে অনেক চিকন ইট পাওয়া যায়।তাছাড়া এই পাড়ার যে কোন জায়গায় মাটি খনন করলে পুরাতন চিকন ইট ও মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যায়।

মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার সার্ভে-২০২০ এর মতামত অনুযায়ি, দুই-তিনশ' বছর আগে সাধারণ মানুষের স্থায়ী বসাবস ছিল না। তখন রাজবংশের মানুষের ক্ষমতা পরিবর্তন হতো। যার ফলে সঠিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন। জনশ্রুতি ৩০ শতাংশ, পরিদর্শন ৫০ শতাংশ এবং বই-পুস্তক ২০ শতাংশ মিলে একটি ইতিহাসের অনুমান পাওয়া যায়।

হিম্মতনগর, ডেকুরা, তাজপুর গ্রামে মোগল আমলে অনেক রাজপ্রসাদ ছিল যা ১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশ এবং কিছু জায়গা উঠিত হবার কারণে অনেক জায়গার রাজপ্রসাদ মাটির নীচে দেবে যায়। এ ধরণের পরিস্থিতি এ গ্রামগুলোতে হয়েছে বলে ধারণা হয়েছে। যার ফলে ধ্বংসাবশেষ জঙ্গলে পরিণত হয়। প্রকৃতিগতভাবে একটি বটগাছ একজন ওলির মাজারকে শত বছর ধরে চিহ্নিত করে রেখেছে! খনন করলে মাটির নীচে ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেতে পারে।

এ দেশে নবী-রাসুল ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে আগমন করেছেন বলে জানা যায় না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একদল সাহাবি আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওয়াহাব (রহ.)-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে চীনে আগমন করেন।

এরপর একে একে আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে পীর, ফকির, দরবেশ, ওলি-আউলিয়া ও সুফি সাধকদের এ দেশে আগমন ঘটতে থাকে। 

তবে ১১ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত এ দেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বিজয়ের আগে খ্রিস্টীয় ১১-১২ শতাব্দীতে যেসব গাউস, কুতুব, সুফি-সাধক এ দেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (রহ.) (১০৫৩ খ্রি. /৪৪৫ হি.) মোমেনসিং পরগনায় ইসলাম প্রচার করেন। নেত্রকোনার মদনপুরে তাঁর মাজার রয়েছে।

খ্রিস্টীয় ১৭-১৮ শতাব্দীতে যে কয়জন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - আলী শাহান শাহ আদম কাশ্মীরি (রহ.) (-১৬১৩ খ্রি.)। তিনি টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া (আতিয়া) অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত আতিয়া মসজিদের কাছে তাঁর মাজার শরিফ অবস্থিত।

আগস্ট ১৯, ২০২০

মন্তব্য করুন: