• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

অপরাধ

যেভাবে অঢেল সম্পদ-বাড়ি-গাড়ির মালিক পাপিয়া দম্পতি

সময়বিডি ডেস্ক

 প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

যেভাবে অঢেল সম্পদ-বাড়ি-গাড়ির মালিক পাপিয়া দম্পতি

র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শামীমা নূর পাপিয়া-মফিজুর রহমান দম্পতির অঢেল সম্পদ ও একাধিক গাড়ি-বাড়ির খোঁজ মিলেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাদের গ্রেপ্তারের পর টানা ১৬ ঘণ্টা নরসিংদী ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে র‍্যাব।

অভিযানে রাজধানীর ফার্মগেট ২৮ ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা, বিদেশি মদ, পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গেছে, কিভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাপিয়া দম্পতি গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। 

রোববার বিকেল ৫টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব -১-এর সিও (কমান্ডিং অফিসার) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল এসব তথ্য তুলে ধরেন। 

এদিকে প্রতারণা, অবৈধ অর্থ পাচার, জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা ও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়াকে (২৮) আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে সংগঠনটি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, গতকাল বেলা ১১টার দিকে পাপিয়াসহ চারজনকে আটকের পর তাদের দেওয়া তথ্যমতে অভিযান শুরু হয়। সারারাত অভিযান চলার পর আজ দুপুরে সেটি শেষ হয়। ফার্মগেট ২৮ ইন্দিরা রোডের 'রওশনস ডমিনো রিলিভো' নামে বিলাসবহুল ভবনে তাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। 

সেখানে অভিযানের সময় লাইসেন্সবিহীন একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, ৫ বোতল বিদেশি মদ, নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক বই, কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।

র‍্যাবের অধিনায়ক বলেন, এই জিজ্ঞাসাবাদে বর্তমান সম্পদ ও বিলাসবহুল জীবন সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকা সত্ত্বেও এই দম্পতি স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। ফার্মগেটে দুটি ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট ও দুটি দুই কোটি টাকা দামের প্লট, বিলাসবহুল ৪টি গাড়ি (কালো ও সাদা রঙের দুটি হাইয়েচ মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়া ও একটি ভিজেল কার) ও বিএফডিসির সামনে কার এক্সচেঞ্জ নামে একটি গাড়ির শোরুম রয়েছে তাদের। 

কার এক্সচেঞ্জ শোরুমে পাপিয়ার এক কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। নরসিংদী শহরে কেএমসি কার ওয়াস অ্যান্ড অটো সলিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে ও বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন আসামীরা। এ ব্যাপারে র‍্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। 

তিনি আরও  বলেন, গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্ট কক্ষ ভাড়া নিয়ে এই দম্পতিকে অবস্থান করতে দেখা যায়। সেখানে তারা ৫৯ দিনে মোট ৮১ লাখ, ৪২ হাজার ৮৮৮ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন। এর বাইরে হোটেলের বার এককভাবে ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা বিল দিতেন। এত বিপুল অর্থের উৎস জানতে চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। 

প্রাথমিক অনুসন্ধানে টাকার উৎস সম্পর্কে কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে র‍্যাবের সিও বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান নরসিংদী এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স প্রদান, গ্যাস লাইন সংযোগ ইত্যাদির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। 

এই পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, পাপিয়া দম্পতি পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নামে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেওয়ার নাম করে ২৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তবে টাকার বিনিময়ে কারও কোনো সংযোগ দিতে পারেননি তারা। তাছাড়া নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন। 

শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়া দম্পতির আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে, নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সি মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। এদের অধিকাংশকেই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হতো। এসব অনৈতিক কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে পাপিয়া দম্পতিসহ আসামীরা বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া মেয়েরা। 

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, নরসিংদীতে এই দম্পতির 'কিউ অ্যান্ড সি' নামে একটি ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। ওই বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের হাতে ট্যাটু করা আছে। তাদের কাছে সব সময় আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। তাদের দুটি হাইয়েচ গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তারা সেই গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে বেড়ায়। তাদের ৫টি মোটরসাইকেলও রয়েছে। এসব গাড়িতে মাসোহারা আদায়, চাঁদাবাজির টাকা উত্তোলন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা দেখাশোনা করতো তারা।  তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। 

এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, 'টাকা ব্যাংকে না রেখে বাসায় কেন রেখেছেন- তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পাপিয়া। আমরা অনুসন্ধান করছি, টাকার উৎস বের হবে।' 

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমে অর্থ পাচার ও জাল মুদ্রা রয়েছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান ও তাদের দুই সহযোগীকে আটক করা হয়। এরপর চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো বেরিয়ে আসে। 

অপর এক প্রশ্নের জবাবে সিও বলেন, কারও সঙ্গে ছবি থাকলেই যে কেউ জড়িত থাকবে, তা নয়। এখন যেকেউ ছবি তুলতে চাইলে অনুমতি দেন। এসব দায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমরা আসামীদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় অস্ত্র, মাদক ও অর্থ পাচার মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়েছি।

পাপিয়া যুব মহিলা লীগের পদ বাগিয়ে অভিজাত এলাকায় জমজমাট নারী ব্যবসাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে নেতাদের ফুল দিয়ে সেই ছবিও অপব্যবহার করতেন।আর এ অর্থ খরচের কারণেই গোয়েন্দাদের চোখ পড়ে পাপিয়ার ওপর। একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে তার সব অপকর্মের কাহিনী।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই তার আয়ের মূল উৎস। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরাই এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে স্কট সার্ভিস খুলে বসে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে তাদেরকে ধণাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী করতেন পাপিয়া। সে একাধিক অভিজাত হোটেলের রুম ভাড়া নিতেন নামে-বেনামে।

পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। এক সময় নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন সুমন। পরে ছিলেন নরসিংদীর প্রয়াত পৌর মেয়র লোকমানের বডিগার্ড।

নরসিংদীবাসী জানান, নরসিংদী শহরের ব্রাক্ষন্দী মহল্লার মতিউর রহমানের ছেলে মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সুমন। প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের দ্বারা রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার। শৈশব থেকেই সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুমন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই হত্যাকাণ্ডের এজহারভুক্ত আসামি সুমন ওরফে মতি সুমন। হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে তার উত্থান। ২০০৯ সালে প্রেমের সম্পর্কে পর পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করেন সুমন।

সুমনকে বিয়ের পর পাপিয়া রাজনীতিতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। লোকমান হত্যাকাণ্ডের বছর তিনেক পর পাপিয়া চৌধুরীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই সময় পাপিয়াকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এরপর তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তাদের। এরপর থেকে পাপিয়া চৌধুরী ও তার স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমন রাজধানীর সাবেক এক সংরক্ষিত এমপির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই এমপির সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসা আছে বলে জানা গেছে।

এরপর ২০১৮ সালে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হয় পাপিয়া। নরসিংদীর শহরের ভাগদী এলাকায় কেএমসি কার ওয়াশ নামে একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টার রয়েছে তার স্বামী সুমনের। নরসিংদীতে রয়েছে সুমন ও তার স্ত্রী পাপিয়ার বিশাল কর্মীবাহিনী। মাঝেমধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে। পাপিয়ার স্বামী সুমন ঢাকায় সন্ত্রাসের পাশাপাশি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

নরসিংদী জেলা শহরে ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় পাপিয়ার বাবা সাইফুল বারীর বাসা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় একটি দোতালা পাকা বাড়ি তার বাবার। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণদীতে চারতলা একটি বাড়ি আছে।

নরসিংদীর শহরের ব্রাক্ষন্দীতে পাপিয়ার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে বাড়ির দারোয়ান জানান, বাসার সবাই ঢাকা চলে গেছে। এদিকে পাপিয়ার বাবার বাড়ি ভাগদীতে গিয়ে জানা যায়, পাপিয়া আর সুমন প্রায়ই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ীক কারণে নরসিংদী আসতেন। তবে কি কারণে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তা জানেন না বলে জানান তার বাবা সাইফুল বারী। সকালে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে তাদের সম্পর্কে জানতে চান বলে জানান। তবে এলাকাবাসী তাদের সম্পর্কে ভয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।

এদিকে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিন ভূঁইয়ার কাছে তাদের বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান, এটা সুমন ও পাপিয়ার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই জায়গায় রাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত নয়। তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে নাম ভাঙিয়ে ঢাকা কি করছে সেটা দেখার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতার করেছে তারাই সব বের করবে। আর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে কেন্দ্রীয় নেতারা।

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০

মন্তব্য করুন: