• ঢাকা

  •  মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৪

সাহিত্য-সংস্কৃতি

একটি কলমের আত্মকাহিনী ǁ সাদিয়া আফরিন অনন্যা

সাদিয়া আফরিন অনন্যা

 প্রকাশিত: ১৪:৫৭, ৭ জুন ২০২০

একটি কলমের আত্মকাহিনী ǁ সাদিয়া আফরিন অনন্যা

আমি কলম। আরিফের সবচেয়ে পছন্দের কলম। আমার সামনেই কত কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু, আমি একটু স্পেশাল। ক্লাসটেস্টে ফার্স্ট হওয়ায় আরিফের বাবা উপহারস্বরূপ আমাকে দিয়েছিল। পুরোনো হলেও আমি আরিফের বুক পকেটে অথবা জিন্সের পকেটে শোভা পাই। গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখনীতে আমাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।

আরিফের সাথে আমার কাটানো সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হচ্ছে ওর এসএসসি পরীক্ষার সময়টা। ঘুম থেকে উঠে কোনোরকম হাত-মুখ ধুয়েই পড়তে বসে যেত আরিফ। নিজের হাতে খাওয়ার সময়টাও পেতো না। ঘড়িতে ৯.৩০ বাজলেই আরিফের বাবা বাইকে চড়িয়ে আমাদেরকে পরীক্ষার হলের সামনে নিয়ে যেত।
সেখান থেকে আরিফের হৃৎস্পন্দন খুব বেড়ে যেত। কেউ না বুঝলেও বুক পকেটে থাকা আমি ঠিকই টের পেতাম।

পরীক্ষা শুরু হলে ওর চোখ-মুখের উজ্জলতা দেখে বুঝতাম প্রশ্ন কমন পড়েছে। আমিও মহানন্দে লেখা শুরু করে দিতাম। কয়েক পৃষ্ঠা লেখার পর আমি অব্যাহতি পেতাম যাতে আমার কালি শেষ না হয়ে যায়। তখন বেঞ্চের এক কোণায় শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকতাম আরিফের দিকে। লিখছে, মাথা চুলকাচ্ছে, চুল টেনে ছিড়ছে আরো কত ভাবভঙ্গি করত এই তিন ঘন্টায়। শেষের দু তিন পৃষ্ঠা লেখার জন্য আবার আমাকে হাতে তুলে নিত। পরীক্ষার শেষের সময়টাতে সে কি যুদ্ধ!শিরা-উপশিরায় টান ধরত, পেশী অবশ হয়ে পড়ত। তাও...থেমে থাকা যাবে না। আমি ঝড়ের বেগে লিখেই যেতাম।

কিন্তু, গণিত পরীক্ষায় আরিফ আমার সাথে মোটেও ভালো ব্যবহার করেনি। 

দাঁতে কামড়ে আর থুথু লাগিয়ে আমার ক্যাপটাকে একেবারে পিষে ফেলেছে। সূত্র মনে না পড়লে আমাকে মেরে কি হবে! পরে অবশ্য কালি শেষ হওয়া একটা কলমের ক্যাপ আমায় পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের রূপ ফিরে পেয়েছি।

পরীক্ষা শেষ। এবার আমার বিশ্রামের পালা। দেখতে দেখতেই রেজাল্টের ডেট চলে এলো।

আরিফের বাবা ঘন ঘন বারান্দায় পায়চারী করছেন। আরিফ ফোন ঘাটছে রেজাল্টের জন্য। আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

একটুপরই বাসায় তুমুল ঝগড়া বেধে গেলো সাথে অসম্ভব রকমের বকাঝকা। কথাবার্তায় বুঝলাম রেজাল্ট সুবিধার না। সে নাকি ৪.৯৪ পেয়েছে। সবাই এতো বকছে ওকে দেখে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। শাসনের লেভেল দেখে বুঝে গেলাম - আরিফ ফেল করেছে। এখন ফেল করাকেই ৪.৯৪ বলা হয় বোধ হয়। এই রেজাল্ট নিয়ে ডাক্তার হয়ে মায়ের আশা পূরণ করা যায় না। ল' নিয়ে পড়ে বাবার আশা পূরণ করা যায় না। কলেজেও ভর্তি হওয়া যায় না।

রাত দুইটা.. দরজা লাগিয়ে ফ্যানের সাথে শক্ত করে একটা বেল্ট বেধেছে আরিফ। আত্মহত্যার প্রস্তুতি! আমি অসহায়ের মত শুধু দেখছি। কিছু করব সে শক্তি নেই একেবারে। ইসস... আরিফ যদি আমার কথা শুনতে পেত!

জীবনটা অন্যরকমও হতে পারতো। হয়তো ঘুরে দাঁড়াতো। ফাঁসির রায় শুনিয়ে দশ বারোটা কলম কচ করে ভেঙে ফেলতে পারত কিংবা ছোট্ট একটা কাগজে হিজিবিজি করে ওষুধের কঠিন কঠিন নাম লিখে দিতে পারত। কিন্তু কোথায় কী! আমার কথা ওর কান পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ও চলে গেল।
-------
আমি থেকে গেলাম কলমদানির এক কোণে। আমার অবসর আর অযত্ন সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। সময় আসলেই পাল্টায়। আরিফের ছোট ভাই সাইফের বুক পকেটে আমার জায়গা হলো। ও আমার খুব যত্ন করে। পরম ভালোবাসায় আমি হয়ে গেলাম সাইফের লেখার সঙ্গী।

আজকে সাইফকে নিয়ে সবার ব্যস্ততা। এসএসসি পরীক্ষা। আবার একটা ব্যস্ত সকাল। সময়ের সাথে অজানা ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরছে। পরীক্ষা শুরুর ঘন্টা বেজে গেছে - সাইফ লিখছে আর আমি কেবলি বলে যাচ্ছি-

আর হারাতে চাই না। সব পেয়ো।শুধু ৪.৯৪ পেয়ো না।#

মন্তব্য করুন: