• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

ফিচার

ময়মনসিংহের ৫০০ বছর আগের শহর বাইগনবাড়ি

রায়হান উদ্দিন সরকার

 প্রকাশিত: ১৬:৩৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

ময়মনসিংহের ৫০০ বছর আগের শহর বাইগনবাড়ি

বাইগনবাড়ি ময়মনসিংহের একটি অন্যতম প্রাচীন নগরী। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে বাইগনবাড়ি নদী ও আদি ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থলে বাইগনবাড়ি শহর ভারতবর্ষে বেশ পরিচিত ছিলো। একসময় বাইগনবাড়ি পশ্চিম ময়মনসিংহের রাজধানী এবং বোকাইনগর পূর্ব ময়মনসিংহের রাজধানী ছিলো।

কামরূপ শাসন আমলে অর্থাৎ পাচঁ-ছয়'শ বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিলো, যা মুঘল এবং রেনেলের মানচিত্রে প্রমাণ মিলেছে। ১৭৮৭ সালের আগে বাইগনবাড়ির পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রস্তততা ছিলো বর্তমান বাংলাদেশের প্রবেশ মূখে অর্থাৎ কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের মতো।

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/vRrQoO_ljmA" width="720"></iframe>

আবার নদীগর্ভে বিলিনও হয়ে যায়। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদী যমুনা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের নিকট পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। কিন্তু আগে ব্রহ্মপুত্রের গতি গারো পর্বতমালার পশ্চিম দিক দিয়ে পূর্ব দক্ষিনে প্রবাহিত হয়ে জামালপুর, ময়মনসিংহ ও মধুপুর জঙ্গলের পাশ দিয়ে ও ঢাকা জেলার পূর্বাঞ্চল হয়ে লাঙ্গলবন্দ ও সোনারগাঁও পাশে রেখে শেষে নারায়নগঞ্জের ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত ছিলো।

ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্সের যৌথ প্রয়াসে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে প্রাচীন নদীবন্দর বাইগনবাড়ি ও আলাপসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়।

দেখে নেওয়া যাক বাইগনবাড়ি একটি পুরনো শহর ও বন্দর, যার প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের ছাপ।

বাইগনবাড়ি নদী:
রেনেলের মানচিত্রে বাইগনবাড়ি নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বাইগনবাড়ি নদীর সম্পর্কে কেউ জানে না। তবে সুতিয়া নদী বেগুনবাড়ির সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলেছে। এ থেকে জানা যায়, বেগুনবাড়ির আদি নাম বাইগনবাড়ি এবং সুতিয়া নদীর আদি নাম বাইগনবাড়ি নদী। তবে বেগুনবাড়িতে রেল স্টেশনের নাম বাইগনবাড়ি রেল স্টেশন হিসেবে এখনও বিদ্যমান।

ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, বাইগনবাড়ি নদীর নাম অনুসারে শহরের নাম হয়েছে বাইগনবাড়ি। এক সময়ে নদীর চরগুলিতে প্রচুর বেগুন চাষ হতো এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বেগুন (বাইগন) রপ্তানি করা হতো। তাই নদীর নাম বাইগনবাড়ি।

আবার অন্যান্য গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, কামরূপ শাসন আমলে বাইগনবাড়ি নামকরণ করা হয়েছে। ওই সময় প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে জাত, ফলন ও প্রকৃতির নাম অনুসারে বন্দর, শহর, নগর ও রাজ্যের নাম দেওয়া হতো। যেমন - জঙ্গলবাড়ি, বাসাবাড়ি (বাশেঁরবাড়ি), বড়ইবাড়ি, কমলাবাড়ি, রাজাবাড়ি, ভূটিয়ারবাড়ি, যাত্রাবাড়ি ইত্যাদি। শেরপুর জেলার সীমানায় এবং আসাম প্রদেশে রেনেলের মানচিত্রে বাইগনবাড়ি কুঠির সন্ধান পাওয়া গেছে।

বাইগনবাড়ির রোড ম্যাপ:
ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্রের বর্ণনায় বাইগনবাড়ির রোড ম্যাপের কথা উল্লেখ্য আছে। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত বই A Description Of The Roads In Bengal And Bahar এবং A General Map of the Roads in Bengal ,1778 কর্তৃক সংরক্ষিত বইটিতে মানচিত্রসহ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্করোডের ৫টি সংযোগস্থল বা বাইগনবাড়ির পাঁচ রাস্তার মোড় পাওয়া গেছে। এ তথ্যের অভাবে সাধারণ মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেছে এই ইতিহাস কথা।

বাইগনবাড়ির রোড ম্যাপ ও ডাটা তথ্য দেখে বোঝা যায়, বাইগনবাড়ি অতি প্রাচীন শহর।তাছাড়া জেমস রেনেলের বইয়ের মানচিত্রের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে, কলকাতা থেকে পরানগঞ্জ পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৯৮ মাইল এবং বাইগনবাড়ি পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৯৪ মাইল।

সুলতান, মুঘল ও পাঠান আমলের বাইগনবাড়ি:
বাইগনবাড়ি সুলতান, মুঘল ও পাঠান আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পশ্চিম ময়মনসিংহের আলাপসিং পরগনাসহ অন্যান্য পরগনার কামরূপ শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে সুলতান, মুঘল ও পাঠানদের রাজধানী ছিলো। ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর খাজা উসমান খাঁ ১৬০৯ সালে মোমেনসিং পরগনার বোকাইনগর ত্যাগ করার আগে লক্ষাধিক সৈন্য বাহিনী নিয়ে মুঘল আগ্রাসন প্রথমে বাইগনবাড়ি দখল করে এবং সেখানে রাজত্ব শুরু করা হয়।

ইংরেজ আমলে বাইগনবাড়ি শহরের ৯০ ভাগ ধ্বংস হওয়ার কারণ - ১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশ এবং কিছু জায়গা উঠিত হবার কারণে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে একটি যমুনা নদী সৃষ্টি হয় এবং পদ্মার সাথে মিলিত হয়। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ৮০ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী প্রায় এক কিলোমিটার প্রশস্থের বাইগনবাড়ি নদী শতবছর আগে সুতিয়া নদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

বর্তমানে বাইগনবাড়ি নদী বলতে কিছু নেই সেখানে আছে শুধু গাঙ বা ছোট নদী। বেগুনবাড়ি বাজার হতে আধা কিলোমিটার উত্তরে রেল লাইনের সাথে এবং সুতিয়া নদীর পাড়ে একটি জায়গা দেখিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা হাজী মো. বেলায়েত হোসেন (আর্মি পারসোনাল অবঃ) বলেন, বেগুনবাড়ির অনেক ইতিহাস রয়েছে। সুলতান, মুঘল ও পাঠান আমলে এ জায়গায় বিশাল বাজার ছিলো। এখানে হাতি ঘোড়া ও অস্ত্র সামগ্রী বেচাকেনা হতো। শত শত কামার দিন-রাত অস্ত্র তৈরি করতো। চীন থেকে লোহা, জলপাইকুড়ি থেকে হাতি, ইরান থেকে ঘোড়া আমদানি হতো। মুঘল বা পাঠান রাজত্বের সময়ে বাইগনবাড়ির ঘোড়ার বাজারে ঘোড়া ছিল। হাতির বাজারে ছিল হাতি। এখন আর সেই বাজার ও লোকের সমাগম নেই। পড়ে আছে কেবল ধান ক্ষেত। (বাইগনবাড়ির জরিপ সময়: ২০ অক্টোবর ২০২০)

ইংরেজ আমলের বাইগনবাড়ি:
বাইগনবাড়ির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থান। বাইগনবাড়ির সম্বন্ধে গবেষণা ও লেখালেখি করার জন্য অনেক তথ্য রয়েছে। বাইগনবাড়ির অবস্থান ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলায়। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে বেগুনবাড়ি গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। 

ঐতিহাসিক বাইগনবাড়ি রেল স্টেশনে দুলাল চন্দ্র ঋষি (৭৫) বলেন, রেল স্টেশনের পাশে চারটি পাট গুদাম ছিলো। তিনি গুদামে কাজ করতেন এবং তার বাপ দাদারও কাজ করতো। প্রতি চার মণ পাট দিয়ে একটি প্যাকেট তৈরী হতো। প্যাকেটগুলি এখান থেকে চট্রগ্রাম ও কলকাতা বন্দরে নেওয়ার জন্য বুক করা হতো। বিনোদনের জন্য বেগুনবাড়ি বিখ্যাত ছিলো। বেগুনবাড়ি বাজার হতে আধা কিলোমিটার উত্তরে ছিলো বিশাল বাইজীপাড়া ও নীলকুঠি। চিত্তাকর্ষক মনোরম কেন্দ্র হিসেবে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ইংরেজদের সাহেব কাচারী, বাণিজ্যকুঠি, কালেক্টর অফিস, থানা, ক্যান্টনম্যান্ট, নৌ ও স্থল বন্দর।

রেনেলের তথ্য অনুযায়ী নৌ পথে বাইগনবাড়ি হতে কলকাতার দূরত্ব ৪৯৪ মাইল। বাইগনবাড়ি বন্দর হতে ময়মনসিংহ জেলার গোড়াপত্তন শুরু হয়। (বাইগনবাড়ির জরিপ সময়: ২০ অক্টোবর ২০২০)

নতুন শহরের পরিকল্পনা ও নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস:
১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে বাইগনবাড়ি শহরের ৯০ ভাগ ধ্বংস হওয়ার পর  ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার জন্য জরিপ কাজ শুরু করেন। এ জরিপের তথ্য জানতে গিয়ে নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাসের আরেকটি তথ্য কচ্চুয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে বের হলো।

’কচ্চুয়া গোষ্ঠীর উৎস সন্ধান ও ক্রমবিকাশ’ এর তথ্যসূত্র অনুযায়ী, আড়াই’শ বছর আগে ময়মনসিংহ শহরে নাসির উদ্দিন মোড়ল নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। পৈত্রিকসূত্রে তিনি ১০০ একর জমির তালুকদার ছিলেন। তার ৮০ ভাগ জমি ছিলো জঙ্গল এবং ২০ ভাগ ছিল আবাদী জমি ও চর। নাসির উদ্দিনের পিতা লস্কর মাহমুদ খুব সাহসী ও বীর ছিলেন। লস্কর মাহমুদ এক সময়ে জঙ্গলে কয়েক ঘন্টায় বন্য মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ করে মহিষের শিং ভেঙ্গে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাকে দেখার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে অনেক লোক এসেছিলো। এই নাসির উদ্দিনের জমি দেখে ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার পরিকল্পনা করেন।

জরিপে দেখেন বন-জঙ্গল থাকার কারণে জায়গাটা খুব উচু, বন্যা ও প্রাকৃতিক মোকাবেলা খুব উপযোগী। এখানে শহর তৈরি করলে টিকসই হবে। ইংরেজদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেগুনবাড়ির কালেক্টর অফিসে নাসির উদ্দিন মোড়লকে ডাকা হয়। নতুন শহর তৈরি করার জন্য নাসির উদ্দিনের সমস্ত সম্পত্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রয় করতে চায় এবং বিনিময়ে তাকে দ্বিগুন অর্থসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। প্রথম প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশীদের চাপ এবং পূর্ব পুরুষদের ভিটা জমি ও কবর স্থান দেখিয়ে বিক্রি করতে অনীহা প্রকাশ করেন। ইংরেজরা এই বিষয়টি জানার পর খুব আশ্চর্য হন।

পরে বানিয়াদের সহযোগিতা নিয়ে ইংরেজরা শহরের নাম নাসিরাবাদ নামকরণ করে নাসির উদ্দিনের সমস্ত জমি কিনে নেন।  প্রচুর অর্থ পেয়ে নাসির উদ্দিন চারটি বিয়ে করে ১৮ জন শক্তিশালী ছেলে ও ১ মেয়ে জন্ম দিয়ে কচ্চুয়া গোষ্ঠীর গোড়াপত্তন শুরু করেন। ৩০ বছর পর নতুন শহরে নাসির উদ্দিনের ছেলেদের মাস্তানী শুরু হয়। আদিপত্য বিস্তারের জন্য কোথাও মারামারি, এমনকি খুন হয়। তাদের তান্ডবে নাসিরাবাদ শহরে সব সময় থমথমে অবস্থা বিরাজ করতো। পরে এলাকার জমিদাররা নাসির উদ্দিনের ছেলেদের বিরুদ্ধে কাহিনী বিবৃত করে অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ইংরেজ প্রশাসন তদন্তের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধি পাঠান। আদালতের সম্মুখে নাসির উদ্দিনের নাতিসহ ৬০ এর অধিক জনসংখ্যার বিস্তার এবং আত্মীয় স্বজনসহ শতাধিক মানুষের উপস্থিতি দেখে ইংরেজরা বিচলিত হয়েছিলেন। তখন থেকে কচ্চুয়া গোষ্ঠীর নামকরণ হয়।

নাসির উদ্দিন মোড়লের বংশ বিস্তার এবং জমিদারদের সঙ্গে গোলযোগের আশঙ্কা দেখে তার ছেলেদের ’মাইগ্রেট’ বা শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইংরেজরা একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংরেজ কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ ও তাদের সম্পতির ভাগাভাগির অর্থ নিয়ে আসাম, সিলেট, হালুয়াঘাট, তারাকান্দা, গৌরীপুর, সদরের দীঘারকান্দাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছেলেরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমান কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৫ হাজার অধিক। 

কেবল কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা তাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস বহুদিন ধরে লালিত করে আসতেছেন। নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহত করার জন্য এবং কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা সুসংহত করার জন্য ময়মনসিংহের দিঘারকান্দায় একটি সংগঠন গড়ে উঠে। সংগঠনটির নাম ’কচ্চুয়া গোষ্ঠী জন কল্যাণ সংস্থা’। এই সংগঠনের সভাপতি আবুল কাশেম মন্ডল বলেন, নাসিরাবাদ একটি অতীত ইতিহাস বিজড়িত শহর ছিলো। কিন্তু ইতিহাসে এ পর্যন্ত নাসির উদ্দিন মোড়লের কথা আলোচনা আসেনি। এর পেছনে জমিদার আমলের সন্ধানী লেখকদের উন্নসিকতা ও তাচ্ছিল্যবোধ কাজ করেছে। তাছাড়া ইতিহাস বিকৃতি ও নামকরণ পরিবর্তন করা জমিদাররা দায়ী।

ইংরেজ আমলে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার ছেলে সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ'র নামে জেলা তৈরী করা প্রশ্নই আসে না। তা সম্ভব ছিলো মুঘল বা নবাব আমলে। সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করার জন্য বর্তমান লেখকদের  প্রতি আহ্বান রইলো।

সরকারি তথ্য বা উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বর্তমান নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস হচ্ছে - মোগল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন, তার নামেই মধ্যযুগে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ'র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি।

নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন হয়ে ময়মনসিংহ হয় একটি ভুলের কারণে। বিশ টিন কেরোসিন বুক করা হয়েছিল বর্জনলাল অ্যান্ড কোম্পানির পক্ষ থেকে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এই মাল চলে যায় রাজপুতনার নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এ নিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পরবর্তীতে আরও কিছু বিভ্রান্তি ঘটায় রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ রাখা হয়। সেই থেকে নাসিরাবাদের পরিবর্তে ময়মনসিংহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এই সব তথ্য ও বক্তব্যের সূত্র ধরে ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনাসহ প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়।

এই জরিপের অগ্রপথিক, পরিচালক, প্রতিবেদক মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার বলেন, হুসেনশাহ আমলে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বদিক জয় করে ত্রিপুরা পর্যন্ত অধিকার করেন।এমনকি বারো ভূইয়ার শাসন আমলে সমগ্র মোমেনসিং পরগনার একটি জলদুর্গের পরিখা বা প্রাকৃতিক সীমারেখার সন্ধান পাওয়া যায়। মোমেনসিং পরগনার উত্তরে সুসং পরগনা, উত্তর-পশ্চিমে সেরপুর পরগনা, দশকাহনিয়া পরগনা, পশ্চিমে আলাপসিং পরগনা, পূর্বে খালিয়াজুরী পরগনা, পূর্বে দক্ষিনে নাসিরুর্জিয়াল পরগনা এবং দক্ষিনে হোসেনশাহী পরগনা। 

তবে আলাপসিং পরগনার বাইগনবাড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিলো। রেনেলের মানচিত্রে নাসিরাবাদ শহরের কোন চিহ্ন নেই। ১৭৮৭ এর ভূমিকম্প ও বন্যার পর নাসিরাবাদ শহরের সৃষ্টি হয়। নাসির উদ্দিনের ইতিহাস এখানে থেমে গিয়েছিলো। ছিল শুধু ধূসর স্মৃতি। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখছে শুধু কচ্চুয়া গোষ্ঠী। মোমেনসিং পরগনা থেকে ময়মনসিংহের নামকরণ করা হয়।

রেনেলের মানচিত্র অনুসরণ করে ইতিহাসখ্যাত খাজা উসমান খাঁ, মোমেনসিং পরগনার জমিদার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার ছেলে  যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর ইতিহাস সংযোগ করে ময়মনসিংহ ইতিহাসকে আপডেট করা সময়ের দাবি। তাছাড়া, কেমন ছিল সে সময়ের বাইগনবাড়ি? রেনেলের মানচিত্র দেখলেই তা বোঝা যাবে। #

মন্তব্য করুন: