• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

ফিচার

রামগোপালপুর ইউনিয়নে দুই ফকির বাড়িতে তিন ওলির মাজার

রায়হান উদ্দিন সরকার

 প্রকাশিত: ০৮:০৮, ১ মে ২০২১

রামগোপালপুর ইউনিয়নে দুই ফকির বাড়িতে তিন ওলির মাজার

রামগোপালপুর ইউনিয়ন ময়মনসিংহ জেলা অন্তর্গত গৌরীপুর উপজেলার এক প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন যুগ থেকে আজকের রামগোপালপুর যতগুলো সিঁড়ি পার করেছে, তার সব ক’টির চিহ্ন ধরে রেখেছে  জমিদার বাড়ি, নদীর চিহ্ন, মধ্যযুগের মাজার তৎসংলগ্ন ফকিরবাড়ি।

জরিপে দেখা যায়, রামগোপালপুর ইউনিয়নে দুই ফকির বাড়িতে তিন ওলির মাজারের অবস্থান। ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে  মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ হতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। 

জরিপকালীন সময়ে কলতাপাড়া বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে দামগাঁও গ্রামে ঐতিহাসিক নিদর্শন খুজতে গিয়ে আবিষ্কার করা হয় এক ফকিরবাড়িতে দুই ওলির মাজার এবং বিশ্বনাথপুর বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে পুম্বাইল গ্রামে আরও এক ফকিরবাড়িতে এক ওলির মাজারের সন্ধান পাওয়া যায়। নদীর চিহ্ন, প্রাকৃতিক সীমা ও বিবরণ, প্রাচীন জনপদ, ভূমিস্বত্ব, বিভিন্ন শাসনকাল, বাণিজ্য স্থান, পূর্ব ময়মনসিংহে শাসকদের স্মৃতিচিহ্ন ইত্যাদির কালের সাক্ষী মধ্যযুগের মাজারগুলো।

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/z9t6TJiNBeo" width="720"></iframe>

প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য মাজারের গুরুত্ব অনেক। তখন দুই গ্রামের তিনটি মাজার নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এ আবিষ্কারে বদলে দিতে পারে গ্রামগুলির অতীত ইতিহাস। এ অঞ্চলে তিনটি মাজারের কোনো ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। তা গবেষণা, জরিপ, জনশ্রুতি ও কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে তিনটি মাজারের কিছু ইতিহাস তুলে ধরা হলো।
 
দামগাঁও গ্রামে হযরত বোরহান উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর মাজার তৎসংলগ্ন আরও একটি মাজার:

দামগাঁও ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী  গ্রাম। এই গ্রামটি গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত। দামগাঁও ফকির বাড়িতে শত শত বছর ধরে হযরত বোরহান উদ্দিন আউলিয়া (রা.) এর মাজার শরীফ অবস্থান। এই মাজার থেকে ঠিক ৩০ গজ পূর্ব পাশেই বেশ পুরানো নামবিহীন মাজার রয়েছে। এই অজানা সমাধিটি কার, কে বা কারা এই স্থাপনার স্থপতি সেটাও কারোরই জানা নেই। সবাই শুধু লোকমুখে শুনেছেন এর কথা।

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/EWjusudz_9o" width="720"></iframe>

হযরত বোরহান উদ্দিন আউলিয়া (রা.) এর মাজার শরীফের অতীত ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, প্রাচীন যুগে এ অঞ্চলে জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ধুরুয়া গ্রামের বরাবর একটি নদীর প্রবাহ ছিল। বিশ্বনাথপুর গ্রামের পূর্ব নাম চরবিশ্বনাথপুর এ থেকে বোঝা যায়। মধ্যযুগের অধিকাংশ মাজার ছিল নদীর তীরবর্তী স্থানে এবং মাজারের আশপাশে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন মাজারের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো নদীর ভূমিকা স্পষ্ট হয়। প্রাচীনকালের এই চিহ্নিত নদীর গতিপথ থেকেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া  যেতে পারে। নদীর আগের গতিপথে প্রত্নতাত্বিক খনন করা যেতে পারে। তাই মাজারগুলো থেকেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিকদের মতে, দুইজন সুফি সাধক সাতশ' বছর আগে এই ফকির বাড়িতে পরলোক গমন করেন। সুলতানী আমলে মাজার এবং ফকির বাড়িটি খুব আকর্ষনীয় ছিল। সুলতানী আমলের পৃষ্ঠপোষকতায় হযরত বোরহান উদ্দিন আউলিয়া (রা.) এর মাজার ও তার সফরসঙ্গীর মাজার পাকা করা হয়েছিল এবং বাড়ির আশপাশে একাধিক ইন্দারা ছিল। বর্তমান একটি চিকন ইটের ইন্দারা বিদ্যমান রয়েছে। তিনি সফর সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারে আসেন। এটিই ইসলাম প্রচারে আগত প্রথম মিশন। তিনি উপমহাদেশের বহু অঞ্চল অতিক্রম করে পূর্ব ময়মনসিংহে পরিশেষে গৌরীপুর উপজেলায় দামগাঁও গ্রামে আসেন। তখন চলছিল বৌদ্ধ ও কামরূপদের সংঘর্ষ। আবার তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতায় ক্ষতবিক্ষত ছিল লোক সমাজ। এই জটিল মূহুর্তে ইসলামের সুফিবাদের বাণী আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় গোটা সমাজকে। তাই তিনি উদার প্রকৃতির বিচিত্র প্রাকৃতিক শোভার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন ইসলামের বাণী, শান্তির চেতনা। সে চেতনার সারমর্ম ছিল মানবপ্রেমের রসসিক্ত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ। এ কালজয়ী পুরুষের সমাধিস্থলে আজ অনেককিছু অজানা।

জরিপকালীন সময়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে এ মাজার নিয়ে কথা হয়। স্থানীয়রা তাদের পূর্ব পূরুষের মুখে প্রাচীন মাজারের কথা শুনে আসছেন। ফকির বাড়ির মো. রফিকুল ইসলাম ফকির (৬৩) বলেন, হযরত বোরহান উদ্দিন আউলিয়া (রা.) চিশতিয়া তরিকার মধ্যে একজন সূফি সাধক। এ মাজারের নামে পূর্বে পীরপাল দানের কতো শতাংশ জমি ছিল তার জানা নেই। শতবছর আগে ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে ফকির বাড়িসহ এ মাজারের অবস্থান ছিল। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে, চিকন ইট তৈরির মাজারটি পূর্ণঃসংস্কার করা হয়। মাজারের সাথে শতবর্ষী পিতরাজ (বদ্দিরাজ) গাছ রয়েছে। এ গাছের বয়স কেউ বলতে পারে না। গাছের ডালপালা কাটলে অনেকের অসুখ-বিসুখ হয়। 

এই গাছ নিয়ে আরও রয়েছে অলৌলিক ঘটনার কথা ও জনশ্রুতি। নন্দীগ্রাম নিবাসী কাঠ ব্যবসায়ী মিয়া হোসেন (৯৯) বলেন, 'ত্রিশ বছর আগে মাজার সংস্কার করার সময়ে গাছ কাটার জন্য মাজার প্রাঙ্গনে যান। বদ্দিরাজ গাছসহ কয়েকটি গাছ ক্রয় করার মনস্থির করেছিলেন তিনি। তখন সমাধি থেকে ৪/৫ হাত দূরে মস্তক ফুল গাছ নামে একটি গাছ কাটার সময়ে তার করাটটি গাছে আটকে যায়। কাঠ ব্যবসায়ী মিয়া হোসেন (৯৯) বুঝতে পারেন, সমাধির সাথে শতবর্ষী বদ্দিরাজ গাছটি কাটলে তার অনেক ক্ষতি হতে পারে। এই মাজারের অদৃশ্য ঐশ্বরিক শক্তি রয়েছে এবং জ্বীন দ্ধারা পাহারা রয়েছে। তখন সাথে সাথে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা চাইলেন এবং শতবর্ষী বদ্দিরাজ গাছটি আর কাটবেন না, আর কেউ কাটলে তা বাধা দিবেন। এই প্রার্থনায় তার করাটটি গাছ থেকে সরে গেল।'

এ গাছের বিষয়ে বন্ধন মৎস্য হ্যাচারি ও ফিসারিজের মালিক মো. কামাল হোসেন বাবুল বলেন, 'তার জীবনে এতো প্রাচীন পিতরাজ (বদ্দিরাজ) গাছ অন্য কোথাও দেখেনি। গাছের বয়স চার থেকে পাঁচশ' বছর হতে পারে।'

জরিপকালীন সময়ে জানা গেছে, হযরত বোরহান উদ্দিন আউলিয়া (রা.) এর মাজার থেকে ঠিক ৩০ গজ পূর্ব পাশেই বেশ পুরানো নামবিহীন একটি মাজার রয়েছে। তবে মাজারটি যে অতি পুরাতন, সমাধির পাশে সুলতান বা পাঠান অথবা মুঘল বা নবাবী আমলের কাঠগোলাপ গাছটিই প্রমাণ করে। এ গাছের বয়স কেউ বলতে পারে না। গাছের ডালপালা কাটলে অনেকের অসুখ-বিসুখ হয়।

জরিপকালে দেখা যায়, প্রাচীনকালে যেসব মাজার রয়েছে তার পাশে কমপক্ষে একটি করে কাঠগোলাপ গাছ রয়েছে বা ছিল। তাছাড়া চিকন ইট তৈরির মাজারটি পূর্ণঃসংস্কার করা হয়নি। চিকন ইট তৈরির সমাধিটি মাটির সাথে মিশে গেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইন্দিরাসহ মাজারটিকে পূর্ণঃসংস্কার করা অতি প্রয়োজন।

পুম্বাইল ফকির বাড়িতে আধ্যাত্মিক জগতের সুফি সাধকের মাজার: 

পুম্বাইল ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। এ গ্রামটি গৌরীপুর উপজেলা শহর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত। পুম্বাইল ফকির বাড়িতে শত শত বছর ধরে হযরত গোরা শাহ আউলিয়া (রা.) এর মাজার শরীফ অবস্থান। 

জানা গেছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য সুলতানী আমল হতে সরকারিভাবে নানা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বা ভূমিদান করা হতো খরচ নির্বাহের জন্য। একে বলা হতো পীরপাল লাখেরাজ। লাখেরাজ আরবি শব্দ, অর্থ নিষ্কর। মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে ছূফি-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট যেসব লাখেরাজ জমি ছিল, অধিকাংশ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত জমিদারদেরকে দেওয়া হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছে সুলতান আমলে এই মাজারের নামে পীরপাল দানের যে সনদ পাঠানো হয়েছিল, ইংরেজ আমলে পীরপাল দানের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ জমির পরিমান কমানো হয়েছিল। এই মাজারের নামে ইংরেজ কর্তৃক পীরপাল দানের কয়েক শত শতাংশ জমি রয়েছে। ঐতিহাসিক মাজারগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি থাকে এবং খাদিমও থাকেন; অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদে অধিষ্ঠিত হন।

লাখেরাজ  বা পীরপাল দানের জমিতে কোনো বাড়ি তৈরি হলে তখন বাড়িটিকে ফকির বাড়ি বলা হয়। উত্তরাধিকারসূত্রে এই বাড়ির প্রত্যেক সদস্য ফকির উপাধি লাভ করেন। তবে মাজারটি যে অতি পুরাতন পীরপাল দানের শত শত শতাংশ জমিই প্রমাণ করে। 

জরিপকালীন সময়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে এ মাজার নিয়ে কথা হয়। স্থানীয়রা তাদের পূর্ব পূরুষের মুখে প্রাচীন মাজারের কথা শুনে আসছেন। ফকির বাড়ির একজন খাদেম মো. ইব্রাহিম ফকির (৭৩) বলেন, হযরত গোরা শাহ আউলিয়া (রা.)  চিশতিয়া তরিকার মধ্যে একজন সূফি সাধক। এ মাজারের নামে পীরপাল দানের ৩২০ শতাংশ জমি রয়েছে। শত শত বছর আগে ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে এ মাজারের অবস্থান ছিল। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে, মাজারের উপর একটি চৌচালা ঘর তৈরী করা হয়। 

খাদেম মো. ইব্রাহিম ফকির (৭৩) যখন এ কথা বলছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুম্বাইল এফ ইউ ফাজিল মাদরাসার অর্থনীতি বিষয়ের প্রভাষক মো. মাহমুদুল হাসান শামীম। তার মতে, মাজারটি ঐতিহাসিক। মাজারের সঠিক ইতিহাস উদঘাটন করা উচিত। কোনো সুফি সাধক সাতশ' বছর আগে এই ফকিরবাড়িতে পরলোক গমন করেন। সব মাজার লালসালু উপন্যাসের মতো নয়। 

যেমন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার লালসালু উপন্যাসে উল্লেখ করা আছে মূলত গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের সরলতাকে কেন্দ্র করে ধর্মকে ব্যবসার উপাদানরূপে ব্যবহারের একটি ভূয়া মাজারের চিত্র উপন্যাসটির মূল বিষয়। গ্রামীণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ এর প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে, সে কিভাবে সমাজের কর্তা ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে, সেই কাহিনীই ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। বিপরীতে যারা প্রকৃত মাজারের আয় ও ধন সম্পদ আত্মসাৎ করে তারা এক ধরণের লেবাসধারী ব্যক্তিত্ব এবং বিভিন্ন অজুহাতে কথা বলে। তাদেরকেও নিয়ে একটি উপন্যাস তৈরি হতে পারে। 

গ্রামবাসীর দাবি, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাস্তাসহ মাজারটিকে আরও সংস্কার করা অতি প্রয়োজন। 

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, অনেক কিছু মানুষের অজানা রয়েছে। পূর্ব ময়মনসিংহকে পর্যটন নগর হিসেবে দেখতে হলে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট নির্মাণ করা প্রয়োজন। প্রতিটি ঐতিহাসিক বা পুরাতন মসজিদ, মন্দির, মাজার, দুর্গ, রাজপ্রসাদ এক একটি পর্যটন হতে পারে। #

মন্তব্য করুন: