• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

ফিচার

গৌরীপুরের কেল্লা তাজপুরে সুলতানী আমলের টাকশাল!

রায়হান উদ্দিন সরকার

 প্রকাশিত: ১৬:৫৩, ১২ মে ২০২১

গৌরীপুরের কেল্লা তাজপুরে সুলতানী আমলের টাকশাল!

টাকশাল হলো টাকা উৎপাদন বা তৈরি বা প্রবর্তন কেন্দ্র। হাজার বছরের ইতিহাসে কবে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল তা কেউ সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে তখনকার শাসকরাও মুদ্রার ব্যবহার করতেন। নিজেদের সুবিধার্তে শুধু রাজধানী হতেই নয়, অপরাপর প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি হতেও মুদ্রা তৈরি করতে শুরু করেন। মুদ্রাগুলি শুধু সরকারের প্রধান কেন্দ্রগুলির বিভাজনই দেখায় না, বরং শহুরে কেন্দ্রগুলির উত্থান পতনও নির্দেশ করে। সামাজ্যের বিস্তৃতির সাথে সাথে টাকশাল শহরের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। এমনই একটি টাকশাল হলো ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কেল্লা তাজপুরে। যা পোদ্দারবাড়ি নামে পরিচিত। বাংলার অনেক টাকশালের কথা লিপিবন্ধ হলেও অনেক কিছুই রয়ে গেছে অজানা।

লেখক রিচার্ড এম ইটন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ও অক্সফোর্ড, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসসহ বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত The Rise of Islam and the Bengal Frontier,1204-1760 এর সূত্র থেকে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার প্রাচীনকালের মিন্ট টাউন বা টাকশালের তালিকা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায। এ বইয়ে উল্লেখ করা আছে প্রাচীন বাংলার অন্যান্য বৃহত্তর জেলার ন্যায় অবিভক্ত ময়মনসিংহে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মিন্ট টাউন বা টাকশাল যা এ গ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠায় Appendix (Mint Towns and Inscription Sites under Muslim Rulers, 1204–1760) নামে একটি তালিকা রয়েছে।

এ তালিকায় চোখে পড়ে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি টাকশাল। যেমন - গিয়াসপুর (ইং ১৩২২সাল), ঘাগরা (১৪৫২), তাজপুর (১৪৫৯), গুরাই (১৪৬৭), গড় জরিপা (১৪৮৬-৮৯), আতিয়া (১৫০৭), জোহার (১৫৩৪), করটিয়া (১৬১০), এগারসিন্দুর (১৬৫২) এবং মসজিদপাড়া (১৬৯৯)। 

বর্তমান ময়মনসিংহের একটি টাকশালের তথ্যভিত্তিক ইতিবৃত্ত তুলে ধরার জন্য ২০১৫ সাল হতে কাজ করছে দু’টি স্থানীয় সামাজিক সংগঠন- ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স।

প্রাচীনকালে বৃহত্তর বা অবিভক্ত ময়মনসিংহে ৫টি প্রাসাদ দুর্গ নির্মিত হয়। দুর্গের মধ্যে চিকন ইটের নির্মিত দালান-কোঠা এবং দুর্গের চারদিকে মাটির তৈরি প্রাচীর ছিল। তন্মধ্যে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলায় দুইটি দুর্গ ছিল। এ দুটি দুর্গ মোমেনসিং পরগনার প্রাণকেন্দ্র গৌরীপুর উপজেলায় অবস্থান।

মোমেনসিং পরগনায় ছিল পূর্ব ময়মনসিংহের পাঠানদের প্রসিদ্ধ ও অন্যতম সামরিক ঘাটি। সমগ্র মোমেনসিং পরগনা একটি জলদুর্গ হিসেবে কাজ করতো। এ পরগনায় জালের মতো ছোট বড় অনেক নদ-নদী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তাছাড়া দ্বীপ বা চর, জলাশয় এবং গভীর অরণ্য বিদ্যমান থাকতো। বহিঃশত্রু বা জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন স্থানে সামরিক ফাঁড়ি বা জলদুর্গ নির্মাণ করা হতো। মানুষ পায়ে চলাচল করার চেয়ে নৌকা যোগে চলাচল করতো সবচেয়ে বেশি। বিশাল জলদুর্গের অধীনে প্রতি ফাঁড়িতে সর্দারের কাজ ছিল জলদস্যু বা বহিঃশত্রু আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধ করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকা এবং বণিক সওদাগরদের নদীপথে নিরাপদ চলাচল করার ব্যবস্থা করা।

এই পরগনা অন্যান্য পরগনার চেয়ে অনেক বড় এবং একটি বৃহৎ জলদুর্গ ও দুটি প্রাসাদ দুর্গ থাকায় সামরিক ঘাটির জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানে টাকশাল ছিল। কেল্লা তাজপুর ও কেল্লা বোকাইনগর দুটি প্রাসাদ দুর্গ। প্রাসাদ দুর্গে দেওয়ান বা রাজা, প্রধান সেনাপতি, উজির, নাজির, রাজকর্মচারীসহ অনেক সেনাবাহিনী বাস করতো। তাই গৌরীপুরকে ইতিহাস সমৃদ্ধ, প্রত্নসমৃদ্ধ ও দুর্গ নগরী বলা যেতে পারে। 

ফোর্ট বা দুর্গের মানচিত্রে বোকাইনগর ও তাজপুর সুপরিচিত। নিরাপদের জন্য দুর্গের ভিতরে অধিকাংশ টাকশাল বা মিন্ট টাউন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বইয়ের তথ্য ও জরিপে দেখা যায়, তাজপুরে সুলতানী আমলে টাকশাল ও জনশ্রুতিতে পোদ্দারবাড়ি।  প্রায় ২০০ একর ভূমির উপর তাজপুর কেল্লা নির্মিত হয়েছিল।

২০২০ সালে দ্বিতীয় জরিপে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ভূটিয়ারকোনা ও তৎসংলগ্ন শাহগঞ্জ বাজার, তাজপুর, পাচঁকাহনীয়া এবং কুমড়ি গ্রামে চার-পাচঁটি প্রাচীন ছোট বড় নদী এবং পাঠান ও মুঘল আমলের রাজ প্রাসাদ, টাকশাল, দূর্গের প্রাচীর ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল। তা বইয়ের সূত্র, প্রাচীন মানচিত্র, জরিপ, গবেষণা, জনশ্রুতি ও কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে তাজপুরের টাকশালের বিবরণ ও ইতিহাস তুলে ধরা হলো। 

উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ি, সুলতান দ্বিতীয় সাইফুদ্দীন ফিরুজ শাহের (১৪৮৬-১৪৮৯) এক সেনাপতি মজলিস খান হুমায়ন তার কামরূপ অভিযানকালে কেল্লা তাজপুর নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। রিচার্ড এম ইটন তার বিখ্যাত গ্রন্থে উল্লেখিত ময়মনসিংহের টাকশালের স্থান তাজপুরের (১৪৫৯) সময় ও তথ্য অনুযায়ি জানা যায়, ওই সময়ে বাংলার পরবর্তী ইলিয়াসশাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) আমলে কেল্লা তাজপুরে একটি টাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান জনশ্রুতিতে এ টাকশালটি পোদ্দারবাড়ি নামে পরিচিত।

সিলেটে প্রাপ্ত হাটখোলা শিলালিপি থেকে জানা যায়, সিলেটে বারবক শাহের কর্তৃত্ব অব্যাহত ছিল। মির্জাগঞ্জের শিলালিপি থেকে আরও প্রমাণ পাওয়া যায়, বাকেরগঞ্জ অঞ্চলও তাঁর সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বারবক শাহের রাজত্বকালের শেষের দিকে চট্টগ্রামে তাঁর কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশের অধিকাংশ এলাকা ও পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের অংশে তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল।

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/Gz_z26mTzrc" width="720"></iframe>

জরিপকালীন সময়ে গৌরীপুর শহর থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরের কিল্লা তাজপুরে গ্রামে ঐতিহাসিক নিদর্শন খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করা হয় প্রাচীন দালানবাড়ির একগুচ্ছ ধ্বংশাবশেষ। দেওয়ান বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মাটির প্রাচীর শেষ সীমানায় দালানবাড়ির ধ্বংশাবশেষ অবস্থিত। একে স্থানীয় মানুষ পোদ্দার বাড়ি বলে।  

গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে যতোটুকু জানা গেছে তা হলো, অনেক বছর আগে এ বাড়িতে পোদ্দরা বসবাস করতেন, তাই দালানটি পোদ্দার বাড়ি নামে পরিচিত। তখন এ বাড়ি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। সুলতানী আমলের সাক্ষ্য বহনকারী পোদ্দারবাড়ি যা মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটা যে একসময় রাজবাড়ি কারুকার্যে সুন্দর্য অতুলনীয় ছিল, তা এর বর্তমান চিকন ইট ও কারুকার্য ইট দেখলে এখনও সুলতান বা পাঠান আমলের ইমারত বলেই অনুমান করা যায়।

পাতলা ইটের সাথে চুন-সুরকির গাঁথুনি ও পলেস্তেরা দিয়ে নানা কারুকার্যখচিত ছিল। ৬০/৭০ বছর আগে সাপের ভয়ে ইমারতটির ভেতরে প্রবেশ করতো না সাধারণ মানুষ। বর্তমান ভবনের সব কিছু ভেঙ্গে একটি স্তুপে পরিণত হয়েছে। এ প্রত্নস্থলের চারদিকে ধানক্ষেত। তাছাড়া এ স্তুপ থেকে একশ' গজ উত্তরে কয়েক ফুট উচু, জঙ্গলাবৃত একটি মাটির প্রাচীরের চিহ্ন বা ডিবি চোখে পড়ে। 

ইতিহাসের সূত্র ধরে তাজপুর ফোর্টে অবস্থিত ধ্বংসপ্রাপ্ত পোদ্দারবাড়িটিকে টাকশাল বলা যেতে পারে অনেকে মত দিয়েছেন। কেননা, ওই সময়ে রাজবাড়িতে সাধারণ পোদ্দাররা বসবাস করতো না তা সত্য। বাংলার মুসলিম সুলতানরা  বিভিন্ন প্রকার স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রবর্তনের জন্য টাকশাল নির্মাণ করেন। তখন পোদ্দাররা রাজকর্মচারী হিসেবে টাকশালে কাজ করতো। ধাতুকে ছাঁচে ফেলে বানিয়ে দিতো ‘কয়েন’, পরে সেটি নিজেই হয়ে গেলো মুদ্রা বোঝানোর অর্থ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে দুই-তিন হাজার বছর আগেও মানুষ কয়েনের ব্যবহার করতো। তখন বিভিন্ন  ধাতব  যেমন - সোনা, রূপা, তামা, লোহা এবং বিভিন্ন মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি মুদ্রা বিভিন্ন দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যম ছিল। আজ যে টাকা-পয়সা আমরা দেখছি তা কিন্তু একদিনে হয়নি। দীর্ঘপথ পার হয়ে আজকের টাকা-পয়সা এমন রূপ নিয়েছে। প্রাচীন  মুদ্রা ইতিহাসের ধারক-বাহক। সঙ্গত কারণেই এই মুদ্রা ইতিহাস উদঘাটনে সহায়তা করে থাকে।

মুদ্রা মূলত একটি সময়ের প্রতীক রূপ। মুদ্রার আবিষ্কারের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন। ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এখানে ইতিহাস প্রমাণ করে কেল্লা তাজপুরের পোদ্দারবাড়ি একটি টাকশাল। 

জরিপকালীন সময়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে পোদ্দারবাড়ির ধ্বংসাবশেষের ইতিহাস ও জনশ্রুতি নিয়ে কথা হয়। বর্তমান (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০) এ গ্রামের ৯০ বছর বয়সি একজন প্রবীণ মো. নূরুল ইসলাম ফকির বলেন, এ বাড়ির নির্মাণের সঠিক ইতিহাস কেউ জানে না।  তার জানা মতে বিগত পাচঁ-ছয় পুরুষ পর্যন্ত কেউ জানে না এ দালানের ইতিহাস। হয়তো দালান নির্মাণের বয়স ৫০০ বছরের অধিক হতে পারে। তিনি পূর্ব পূরুষদের কাছ থেকে শুনেছেন, দালানে এক সময়ে পোদ্দাররা বসবাস করতো।

মো. নূরুল ইসলাম ফকির যখন কথা বলছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন এ গ্রামের বাসিন্দা মো.ইদ্রিস মিয়া (৮৩)। এ তথ্যবহুল এই আলোচনায় মো.ইদ্রিস মিয়া বলেন, এই ইতিহাসটি শত শত বছরের পুরানো মুখের কথা যা পোদ্দারবাড়ি অথবা দালানবাড়ি হিসেবে শুনে আসছেন। নূরুল ইসলাম ফকির যা বলেছেন তা সত্য। 

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/0twMVFsoNfE" width="720"></iframe>

তাজপুর পর্যটন দিবসে সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন - সাংবাদিক জহিরুল হুদা লিটন, মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব, মহসীন মাহমুদ শাহ, প্রভাষক মো. মোশারফ হোসেন, মোসলেহ উদ্দিন, দেওয়ান সুমন, টেকনোলজিস্ট দিলীপ কুমার দাস প্রমুখ।

গৌরীপুরবাসী বলছে, দালানবাড়ির ধ্বংশাবশেষ পরিস্কার পরিছন্ন করে দর্শনীয় পরিবেশ সৃস্টি করে এটিকে প্রস্তাবিত কেল্লা তাজপুরের জাদুঘরের একটি অংশ হিসেবে টাকশালের স্থান হিসেবে দেখানো যেতে পারে। তাছাড়া দুর্গের প্রাচীরের চিহ্ন স্পটের উপর মাটি ফেলে আরও উচু ও প্রস্থতা করে, প্রাচীরে উপর দুই সারিতে রং-বেরংয়ের গাছ রোপন করে ও আকর্ষণীয় করে একটি পিকনিক স্পট তৈরি করা যেতে পারে। তখন তাজপুরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কৌতুহল সৃস্টি হবে শত শত বছরের পুরনো এই টাকশাল ও মাটির প্রাচীরকে ঘিরে। 

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, অনেক কিছু মানুষের অজানা রয়েছে। প্রবীণ মো. নূরুল ইসলাম ফকিরের পোদ্দারবাড়ির বর্ননা ও টাকশালের ইতিহাস মিলে গেছে। ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য তাজপুরের বিভিন্ন জায়গায় খনন করা প্রয়োজন। খননের বিভিন্ন পর্যায়ে এখানে বেরিয়ে আসতে পারে মুদ্রাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন নিদর্শন। 

ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সফর করেন। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য ছিল হজরত শাহজালাল (র.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায়, তখন এক স্বর্ণমুদ্রারও কম মূল্যে দাস-দাসী কিনতে পাওয়া যেতো। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলার নদী-নালা ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাচীন ইতিহাস ও নিদর্শন খোঁজার জন্য স্বর্ণমুদ্রার গুরুত্ব অনেক। নদীর প্রাক্তন গতিপথে প্রত্নতাত্বিক খনন করা যেতে পারে। ৬০/৭০ ফুট পর্যন্ত প্রত্নতাত্বিক খনন করার পর স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া যেতে পারে। 

এই বিবরণকে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, সে সময়ে নদী পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মুদ্রাসহ অনেক নৌকা ডুবে গিযেছিল বলে ধারণা করা হয়। তখন মুদ্রা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে তাজপুরের শাসকদের ইতিহাস জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রচারের মাধ্যমে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ তাজপুরের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।  টাকশালের কথা আলোচিত হতে হবে। 

পরিকল্পিতভাবে প্রত্নতাত্বিক খনন করার পূর্বে ভৌগোলিক ভাবে আরও কিছু তথ্য সন্ধান পাওয়া গেছে, যা জানা অবশ্যই প্রয়োজন। 

প্রাচীনকালে তাজপুর একটি নদীবহুল এলাকা ছিল। এখানকার সবগুলো নদীই খরস্রোতা ছিল। আড়াইশ' বছর আগের রেনেলের মানচিত্র দেখে মনে হচ্ছে নামবিহীন একটি বড় নদী জঙ্গলবাড়ি হতে শাহগঞ্জ বাজার, তাজপুর ও ভূটিয়ারকোনার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে শ্যামগঞ্জ বাজার নিকটে সোহাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এ নদীর অনেক শাখা নদী থাকা কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছিল। তাই মানচিত্রে নদীর নামটি দেওয়া হয়নি। 

দক্ষিণ হতে ভূরুঙ্গা নদী, বোকাইনগর হতে চামারখালী নদী, গৌরীপুর হতে বালুয়া ও কাইড়া নদী, পাটেশ্বরী নদী হতে সুরিয়া নদী যা শাহগঞ্জ বাজারে মিলিত হয়েছিল। এ বিশাল জলরাশির জন্য ওই জায়গার নাম রাখা হয়েছিল পাচঁকাহনিয়া। পাঠান ও মুঘল আমলে এই স্থানে নদীর বিস্তার অধিক থাকার কারণে নদী পারাপার জন্য পাঁচ কাহন কড়ি নির্ধারিত ছিল। ফলে জায়গাটি পাচঁকাহনিয়া নামে পরিচিত হয়। বর্তমান পাচঁকাহনিয়া একটি গ্রাম হিসেবে পরিচিত। 

কোচ বা ভূটিয়ার যুগে ভূরুঙ্গা মাছের প্রাচুর্য থেকে নদীর নামকরণ করা হয়েছিল ভূরুঙ্গা। বর্তমান সেখানে জল ভূরুঙ্গা হিসেবে পরিচিত। মুঘল আমলে সখিনা ছিলেন বীর নারী ও তাজপুরের দেওয়ান ওমর খাঁর মেয়ে। তার প্রিয় স্বামীর জীবন বাচাঁতে গিয়ে বীরাঙ্গনা সখিনা নিজেই ঐতিহাসিক সুরিয়া নদীর পাড়ে বাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অর্থাৎ ওমর খাঁর সৈন্যদের যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং শহীদ হন। 

ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে এ পরগনার প্রতি দুর্গের বয়স কমপক্ষে ৭০০ বছর। এই গ্রামে প্রাচীন যুগে ভূটিয়ার জনপদ ছিল। দুর্গের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, অনেক শাসক বিভিন্ন সময়ে রাজ্যত্ব করেছিলেন। প্রথমদিকে কামরূপ ও ভূটিয়ারদের অধীনে, তারপর সুলতান আমল, তারপর মোগল আমল, তারপর নবাব আমল এবং ইংরেজ আমল সূচনার প্রথম দিকে এর কাজ সমাপ্তি ঘটে। 

তাছাড়া এ অঞ্চলে  ইতিহাসে আরও একজন আলোচিত শাসকের নামের কথা প্রচালিত রয়েছে। প্রাচীনকালে কোন এক সময়ে কোন এক শাসক ছিলেন তার নাম বাহাদুর খাঁ ও তার বোন ছিমুরাণী। তাদের নিয়ে ট্রাজেডি বা বিয়োগান্ত ঘটনা রয়েছে। কেল্লা তাজপুর সেতু হতে পশ্চিম দিকে সিংরাউন্দ গ্রামে প্রায় ২৫ একর জমির উপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছিমুরাণীর দীঘি। কিছু গুরুত্বর্পূণ কথা হলো ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য কিছু কত্রিম প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা নির্মাণ করা প্রয়োজন। তখন মানুষ ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারবে যতটুকু ইতিহাস নির্মাণ করা হয়েছে। #

মন্তব্য করুন: