• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

বাংলাদেশ

ভাষা সৈনিক মরহুম হাতেম আলী মিয়ার রাজনৈতিক ও কর্মময় জীবন

মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার ও দিলীপ কুমার দাস

 প্রকাশিত: ১৬:৪৭, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

ভাষা সৈনিক মরহুম হাতেম আলী মিয়ার রাজনৈতিক ও কর্মময় জীবন

মরহুম হাতেম আলী মিয়া ১৯২৬ সনের ১৭ ফেব্রুয়ারী ময়মনসিংহ জেলার ঐতিহ্যবাহী গৌরীপুর থানার ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের নন্দুরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জহির উদ্দিন মাষ্টার এবং মায়ের নাম মেহেরুন্নেছা। শিক্ষা জীবনে তিনি গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক এবং গৌরীপুর মহাবিদ্যালয় হতে আইএ পাশ করেন।

১৯৪৬ সালে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৫০ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গৌরীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক পদে ও পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং একইসময়ে তিনি ময়মনসিংহ জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বও পালন করেন।

১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কারনে গ্রেফতার হন এবং ৯ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকায় গিয়ে শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে বছরই তিনি ভাষানী সোহরাওয়াদীর সাথে নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জে সফরে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে গৌরীপুর রেলস্টেশনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানান।

১৯৫৩ সালের ১৩ এপ্রিল গৌরীপুর শহীদ হারুন পার্কে এক বিশাল জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ও মাওলানা ভাষানীর উপস্থিতিতে সর্বপ্রথম তিনি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পান। ১৯৫৪ সালে তিনি রাজনৈতিক কারনে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন।

১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গৌরীপুরে গণমিছিলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচারনায় বঙ্গবন্ধু ময়মনসিংহ হতে নান্দাইল যাওয়ার পথে হাতেম আলী মিয়া কলতাপাড়া বাজারে তার সহকর্মীদের নিয়ে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানান।

১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে হাতেম আলী মিয়া নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে এমসিএ নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালের ৪ মার্চ গৌরীপুর শহীদ হারুন পার্কে বিশাল জনসভায় তার সহকর্মীদের নিয়ে হাতেম আলী মিয়া পাকিস্তানের পতাকাতে অগ্নিসংযোগ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষনের পর তিনি গৌরীপুরে সংগ্রাম কমিটির সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিলের পর তিনি ভারত সরকারের সহযোগিতায় মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়িতে ইয়্যুথ ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং ইনর্চাজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭২ সালে তিনি গণপরিষদের সদস্য হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গৌরীপুর শাখাকে তিনি শক্তহাতে সুসংগঠিত করেন। তৎকালীন সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগষ্ট হাতেম আলী মিয়া তার নিজ বাসভবনে নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ মাহফিল ও কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করেন। খুনী পাক সরকারের রোষানলে শিকার হয়ে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং রাজবন্দী হিসেবে কারাবরণ করেন।

হাতেম আলী মিয়ার আমন্ত্রনে ১৯৮৭ সালে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গৌরীপুর তার বাসভবনে আসেন। পরে স্থানীয় হারুন পার্কে বিশাল জনসভায় ভাষন দেন।

মরহুম হাতেম আলী মিয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। শেখ মুজিব এবং বেগম মুজিব দু'জনই তাকে ভীষণ ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে হাতেম বলে ডাকতেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে তার সর্বস্ব উজার করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী এবং সাধারণ মানুষের মাঝে। জেল জুলুম কারাবরণের মধ্য দিয়ে তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করে চলেছেন  সারাজীবন।

তিনি গৌরীপুর সরকারী কলেজ, গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তৎকালীন সময়ে ইকবাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা ও যুব কিশোর সংগঠন কঁচিকাঁচার আসর, গোবিন্দ জিউ মন্দির প্রতিষ্ঠা ও রাজেশ্বরী বোকাইনগর কালীবাড়ী মন্দির গৌরীপুর শহরে পুন:প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৯৬০ সালে বাউন্ডারী কমিশনের নিকট গৌরীপুরকে জেলায় উন্নীত করার প্রথম প্রস্তাবকারী এবং ১৯৭৫ সালের ১০ জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে গৌরীপুরকে জেলা করার প্রস্তাব ও ১নং মইলাকান্দা ইউনিয়নের কাউরাট বাজারে রেলস্টেশন স্থাপন এবং নিজাম উদ্দিন আউলিয়া এর মাজারের সংস্কারের আবেদন জানান।

তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদের নিজস্ব প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। গৌরীপুর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক সবর্ণ বাংলা পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। তার লেখা অসমাপ্ত গ্রন্থ মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু (অপ্রকাশিত)। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বর্ষিয়ান রাজনৈতিক জননেতা হাতেম আলী মিয়া বার্ধক্য জনিত কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী থাকার পর ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল তার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের এমসিএ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক ও সাংবাদিক হাতেম আলী মিয়ার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল আজ ২৬ এপ্রিল। এ উপলক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও পরিবারের পক্ষ থেকে মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, কবর জিয়ারত ও কুরআনখানির আয়োজন করা হয়।

মন্তব্য করুন: