• ঢাকা

  •  শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

ছুটির ফাঁকে

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-২)

অজিত কুমার দত্ত

 প্রকাশিত: ১২:০৩, ১২ জুলাই ২০১৮

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-২)

আমরা কার্বন কেভ থেকে ফেরার পথে মেরিনা বীচের কাছাকাছি হবে, চলন্ত অবস্থায় ট্রাভেল এজেন্টের একজন  মোটর বাইক নিয়ে ড্রাইভারের হাতে কি যেন দিয়ে গেলো। যাক, আমরা বেশ আনন্দেই আছি মেরিনা বীচে। দুরের রস আইল্যান্ডে এক এক করে লাইট জ্বলে উঠেছে। মেরিনা বীচেও হাজার ওয়াটের ভ্যাপার লাইটগুলি জ্বলে উঠেছে। যেন দ্বিতীয় স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে!

আমরা সাগর পাড়ে জেটি ব্রিজে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে সাগরের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর রকমারি আলোর বাহার দেখে মুগ্ধ! এমন সময় ড্রাইভার বলল, চলুন শো শুরু হয়ে যাবে। ইচ্ছা ছিল আরো কিছুক্ষন সন্ধ্যার সাগরের রূপ উপভোগ করি। কিন্তু উপায় নেই। তাই সবাই আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। সামান্য কিছু রাস্তা এসে গাড়ি থামলো বহুশ্রুত আন্দামান সেলুলার জেলের সামনে। সারা শরীরে একটা শিহরণ অনুভব করলাম। ছোটবেলা থেকেই বহুবার আন্দামান সেলুলার জেলের কথা শুনেছি বাবার মুখে। পড়েছি স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বদেশীদের কথা। সেখানে আন্দামানের দ্বীপান্তরের ঘটনা ও পড়েছি। আন্দামান তখন পরিচিত ছিল কালাপানি হিসেবে।

জেলের সামনে দিয়ে যে চওড়া রাস্তা, তা দিয়ে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাওয়া যায়। তারই পাশে একটু চত্বর রয়েছে। সবুজ সাজানো বাগানের মতো। ভাল লাগলো পরিবেশটা। ততক্ষনে গেটের সামনের জেলখানার ভিতরে যাবার লাইন শুরু হয়ে গেছে। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। ড্রাইভার এসে টিকিট দিয়ে গেলো। ভিতরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে সারি সারি চেয়ার পাতা। অনেকটা সিনেমা হলের আদলে। ইচ্ছেমতো যে কোন সিটে বসা যায়। আমরা সেভাবে বসে গেলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই দুই-আড়াইশ' সিট ভর্তি হয়ে গেলো। তার কিছুক্ষণ পর শুরু হলো লাইট এন্ড সাউন্ড শো।

শো'তে সেলুলার জেলের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অত্যাচারের কাহিনী উপস্থাপন করা হয়। দর্শক মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। সেলে লাইট ও ঘটনার পুনঃনির্মানের মতো লাইট-সাউন্ড সবাইকে অভিভূত করে রেখেছে। কি লোমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনী! কিভাবে ঘানি টেনে তেল বেড় করতে হতো অনবরত। থামার কোন উপায় ছিল না। থামলেই চাবুক মারা হতো। একটা লোক কিভাবে দিনরাত ঘানি টানতে পারে ভাবা যায়না।

ধারাভাষ্যকারের কন্ঠ খুবই পরিচিত মনে হলো। হ্যাঁ বুঝতে পারলাম কন্ঠটা খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার ওমপুরীর। গুরুগম্ভীর ও সাবলীলভাবে ঘটনার আলেখ্য দর্শন বর্ণনা করে যাচ্ছেন তিনি। আর রোমাঞ্চিত এবং শিহরিত হয়ে যাচ্ছে উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী। ফাঁসি হয়েছে ৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর। তাদের দেহ তুলে দেয়নি কোন ভারতীয়ের হাতে শেষ কৃত্যের জন্য। যদি আরও দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে সেই ভয়ে তাদের দেহ সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুনলাম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকেই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। তেমনি একজন উল্লাসকর দত্ত। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কয়েকবার ফাঁসিতে ঝুলে আত্নহত্যা করতে চেয়েছিলেন। শেষে উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেন, যাতে পাগলা গারদে ভর্তি হওয়া যায়। ডাকা হয় মেন্টাল হসপিটালের ডাক্তার। তিনি এসে পরীক্ষা করে দেখেন উন্মাদের তেমন লক্ষণ নেই। একান্তে সব শুনে তার মনে করুনার উদয় হয়। তিনি বললেন এভাবে মারা গেলে তো তোমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নটাই অধরা থাকবে। তার চেয়ে আমি তোমাকে পাগল বলে সার্টিফাই করি, আমার হাসপাতালে পাঠালে, ওখানে তোমার কোন অসুবিধে হবে না। শেষে তাই হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। আরও আছে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস'র জাপানিদের সহায়তায় আন্দামান দখলের কাহিনী। একটা দারুণ অনুভূতি নিয়ে শেষ হল আমাদের প্রথম দিনের আন্দামান সফর। চলবে...

মন্তব্য করুন: