• ঢাকা

  •  শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ছুটির ফাঁকে

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-৪)

অজিত কুমার দত্ত

 প্রকাশিত: ০২:৫৬, ২৪ জুলাই ২০১৮

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-৪)

পরদিন সকালে আমরা জাহাজ ঘাটে এসে হাজির। গত রাতেই সত্যজিৎ সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে। জাহাজের টিকিট, ওখানে কোথায় কিভাবে আমাদের থাকা-খাওয়া সবকিছু। সকালে জাহাজ ছেড়ে যাবে। তাই ভোরেই তৈরি হয়ে নিতে হবে। ডেভিড আমাদের লাগেজসহ সবকিছু জাহাজ ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো।

সকালে সাগরের শীতল হওয়ায় মন ভরে গেল। জাহাজ এখনো জেটিতে লাগেনি। তাই রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটু চা পানের সুযোগ হলো। ততক্ষণে জেটিতে জাহাজ ভিড়ে গেছে। ডেভিডকে বিদায় জানিয়ে চললাম এবার দ্বীপান্তরে। আমাদের গন্তব্য নীল আইল্যান্ড। মানে নীল দ্বীপ।

ঠিক সাড়ে ছ'টায় জাহাজ ছেড়েছে। আস্তে আস্তে তীরভূমি অতিক্রম করে এগিয়ে চলছে জাহাজ। আমরা আমাদের সিটে বসেছিলাম। পেছনে লক্ষ্য করলাম, বেশ কিছু মানুষ মই বেয়ে উপরে উঠছে। আমরাও তাদের অনুসরণ করলাম। কি অপূর্ব দৃশ্য। শান্ত সাগরে ঢেউ তুলে ছুটে চলেছে আমাদের জাহাজ। চারদিকে দূর-দূরান্তের দ্বীপগুলো দেখা যাচ্ছে। সাগরের জল এতো নীল যে, মনে হয় কে বা কারা জলে নীল ঢেলে দিয়েছে। মেঘমুক্ত আকাশ। সূর্য তখনো প্রভাব বিস্তার করেনি। চারদিকের নৈসর্গিক দৃশ্য মনের ক্যামেরায় গেঁথে নিচ্ছিলাম।

উপরে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধে হচ্ছিল। তাই আবার নিচে এসে সিটে বসলাম। আর তখনই একজন বললো, সারেং-এর কেবিন থেকে অপূর্ব লাগে দেখতে। কিছু লোক দেখলাম সে কেবিনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আমরাও অন্যান্য কেবিনের মাঝখানের সরু গলি দিয়ে সেখানে ঢোকার চেষ্টা করলাম। বাপরে কি গরম এখানটায়। একজন তো বমি করে দিয়েছিল। সম্মুখে বিস্তৃর্ণ জলরাশি। দূরের সাগরে ছোট ছোট ইঞ্জিনবোট চলতে দেখলাম।

সারেং-এর কেবিন থেকে ফেরার সময় গরমে অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম। তাড়াতাড়ি নিজের সিটে বসলাম। প্রায় দু'ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে ৮:২০টায় আমরা নীল দ্বীপে পৌঁছলাম। আমাদের জন্য এখানেও গাইড নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সত্যজিতের দেওয়া খামটি তার হাতে দিলাম। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করে জেটি সংলগ্ন হোটেলে ইডলি দিয়ে সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করলো। তার কাছ থেকেই জানলাম দ্বীপের নামকরনের রহস্য।

এই দ্বীপে মোটেও নীল চাষ হয় না। আর সাগরের নীল জলরাশির জন্যও এর নামকরণ হয়নি। গাইডের দেওয়া তথ্যমতে, ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেমস নীল'র নামানুসারেই এই দ্বীপের নাম নীল দ্বীপ হয়েছে।

বলে নেওয়া ভালো, এখানে আমাদের ড্রাইভার বাঙালি। যে হোটেলে খেলাম সেটির মালিকও বাঙালি। মালিক নিজেই খাবার পরিবেশন করছেন। কাউন্টার সামলাচ্ছেন তার মেয়ে বিএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। এই দ্বীপে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। উচ্চমাধ্যমিক থেকে পোর্টব্লেয়ারে গিয়ে পড়তে হয়। দূরত্ব ৩৬ কি.মি.। দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য সরকারি জাহাজে মাত্র ৩৭ টাকা ভাড়া। অন্যদের জন্য ৩০০ টাকা। এই দ্বীপ থেকে যাওয়া আসা করতে দু'ঘণ্টা করে মোট চার ঘন্টা লাগে।

হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো কিলোমিটার খানেক দূরে একটি কটেজে। দারুণ কটেজ। ঝকঝকে পরিষ্কার। বেশ কয়েকটি কটেজ। তিনটি আমাদের জন্য বরাদ্দ। নারকেল বাগানে এই কটেজগুলি ছায়া সুনিবিড়। পঞ্চাশ মিটার দূরে সেই নীল সমুদ্র। একটু এগিয়েই ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ড্রাইভার বললো, এবার স্নানের প্রস্তুতি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। আমরা বেশ কয়েকটি বিচ দেখবো। আমরা প্রথমেই সীতাপুর বিচে গেলাম। এখানে সাগরের গভীরতা ভালোই, দেখতে অনেকটা পুরীর চন্দ্রভাগা বিচের মতো। কিন্তু লোকজন খুবই কম। এখান থেকে আমরা গেলাম ভরতপুর বীচে। এই বিচ বেশ জমজমাট। বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক পাথরের ছোট ছোট দোকান, ডাব বিক্রেতাদের হাকডাক নিকবরী ডাব খেয়ে যান তিরিশ টাকা। গাইড বললো, এ দ্বীপে প্রায় সবাই বাংলাদেশী উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে এখানে ওদের ঠাই হয়েছে। কিছু আছে আন্দামানিজ। তারা দ্বীপের এক কোনে বসবাস করে। তাই পোর্টব্লেয়ারে পাঁচমিশালি লোকজন হলেও নীল আর হেভলকে বাঙালিই বেশি।

আন্দামানের সাগর ঠিক পুরী বা দীঘার মতো নয়। সাগরের সেই উদ্যামতাও নেই । আর দিগন্ত প্রসারিত জলরাশিও নেই। সাগর যেন ভুল করে স্থলভাগে ঢুকে পড়েছে। দূর- দূরান্তের দ্বীপগুলি ঘিরে রেখেছে জলরাশিকে। ভরতপুর বিচে খুবই শান্ত ঢেউ। জোয়ারের সময় তাই জলস্ফীতি। ওয়াটার স্কুটার, গ্লাস বোটে করে অগভীর সাগরে রঙিন মাছের ঝাঁক দেখা বা বোটে করে কয়েকচক্কর সাগরে ঘুরে বেড়ানো সব ব্যবস্থাই আছে। আমাদের আগে যারা এই দ্বীপে ঘুরতে এলো তাদের কাছে বৰ্ণনা শুনে মনে হলো, গ্লাস বোটে ঘুরেই আসি। কিন্তু আমাদের ভ্রমণসঙ্গী ভদ্র বললো, কোন এক মাসিমার সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছে, হ্যাভলকে নাকি আরো ভালো দেখা যায়। তাই বোটম্যানের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে সে ইচ্ছা থেকে বিরত থাকলাম।

সবাই সাগর স্নানের আনন্দ উপভোগ করলাম। মনে হলো কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বীচ বাদ দিয়ে বঙ্গোপসাগরের প্রায় সব কোনেই স্নান হলো। এখানে জল কম। অন্য বীচের মতো নিচে বালিও নেই। শক্ত কোরাল ভর্তি, তাতে চোরাবালির সমস্যা নেই। স্নান সেরে সাগর পাড়ে বসে বেশ ভাল কাটলো সময়টা। অনেকেই সামুদ্রিক পাথরের নানারকম জিনিস কিনেছেন। বিক্রেতারাও যার কাছে যা দাম পাচ্ছে নিয়ে নিচ্ছে। তারপর লাঞ্চের জন্য জেটির কাছের হোটেলে ফিরে গেলাম। লাঞ্চ সেরে রিসোর্টে।

রিসোর্টে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম লক্ষ্মণপুর-২ বিচের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় এক কি.মি. পায়ে হেটে জঙ্গলের রাস্তায় যেতে হয় এই বিচে। মৃত কোরাল জমে শক্ত পাথরের মত হয়ে এই বিচের উৎপত্তি। খালিপায়ে হাটা সম্ভব নয়। এখানে সাগর উত্তাল ও গগন প্রসারিত। জীবন্ত কোরাল দেখা গেলো এখানে। নরম তুলতুলে অবস্থা। মরে শুকিয়ে গেলে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। এখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে আবার ফিরে এলাম রিসোর্টের কাছাকাছি লক্ষ্মণপুর-১ বিচে।

গাইড বললো, নীল দ্বীপের দৈর্ঘ্য ৬.৩ কি.মি. প্রস্থ ৩.৭ কি.মি। জনসংখ্যা মাত্র ৩০৪০ জন। এখানে ধান চাষ হয়। আর এখানকার উৎপাদিত সবজি তো গোটা আন্দামানে সাপ্লাই হয়। গাড়ি থেকে নেমে ৫০০ মিটার জঙ্গলের রাস্তায় হেটে এই বিচে পৌঁছলাম বেলা পৌনে চারটায়। এটি আরেকটি অসাধারণ সমুদ্রতট । বড় বিচ যাকে বলে। বালিয়াড়ি হেটে আমরা এগিয়ে গেলাম একটা জায়গায় যেখানে তিন দিকেই সাগর। দূরে হ্যাভলক আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। দেখলাম নীল থেকে ওই দ্বীপে যাচ্ছে একটি ক্রুজ, ওটা বেসরকারি। বেসরকারি ক্রুজের ভাড়া ৯০০ টাকা।

ইতোমধ্যে দিকচক্রবালে আবীরের রঙ ছড়িয়ে সূর্যদেব অস্তাচলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তারই রঙে রাঙা হয়ে সাগরের জলেও বিম্বিত হতে লাগল অস্ত রবির শেষ আভা। কি অপূর্ব দৃশ্য এই বালুকাবেলায়। সবার ক্যামেরা ঝলসে উঠছে বারবার। আমরা সবাই বিমোহিত। আস্তে আস্তে সাগরের বুকে নেমে এল সূর্য আর তারই নিচে জাহাজ ছুটে চলেছে হ্যাভলকে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। মোবাইল সেট ও ট্যাবের আলোতে জঙ্গলের পথ পেড়িয়ে গাড়িতে উঠলাম। চলবে...

মন্তব্য করুন: