• ঢাকা

  •  শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ছুটির ফাঁকে

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-৫)

অজিত কুমার দত্ত

 প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২৬ জুলাই ২০১৮

দ্বীপান্তরের আন্দামান (পর্ব-৫)

পরদিন সকালে আবার ভরতপুর বিচে গেলাম। সেখানে স্নান সেরে আবার জাহাজ ঘটে। লাঞ্চ সেরে আমাদের গন্তব্য হ্যাভলকে যাওয়ার অপেক্ষায় । আন্দামানের প্রাকৃতিক ভূস্বর্গ! আমাদের মতো বহু পর্যটক অপেক্ষারত। টিকিট কাউন্টারে রীতিমত হুড়োহুড়ি। আমাদের গাইড-কাম-ড্রাইভার টিকিট কেটে এনেছেন। এবার জেটির দিকে এগিয়ে গেলাম। জাহাজ ছাড়ার সময় সাড়ে ১২টা। ইতোমধ্যে জেটিতে ভিড়েছে জাহাজ 'হাট বে'। আমরা গাইডকে বিদায় জানিয়ে জাহাজে উঠলাম।

আজ ভিড়টা একটু বেশিই মনে হলো। টিকিট না পেয়ে অনেক পর্যটক জাহাজে উঠতে পারেন নি। সঠিক সময়েই ছেড়ে গেলো জাহাজ। আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকলো নীলের সবুজপ্রান্তর। বেশ আনন্দে মন ভরপুর আমাদের। এবার আর ছুটাছুটি না করে বসে আছি।

আমাদের পাশের সিটে বসা এক স্থানীয় যাত্রীর সঙ্গে আলাপ শুরু হলো। তার কাছেই শুনলাম হ্যাভলক আন্দামানের বড় দ্বীপগুলোর মধ্যে একটি। যার আয়তন ৪০ বর্গ কি.মি। দৈর্ঘ্য ১৮ কি.মি আর প্রস্থ ৮ কি.মি। নীল দ্বীপে একটি গ্রাম পঞ্চায়েত আর হ্যাভলকে ২টি গ্রামপঞ্চায়েত আছে। আর আছে দক্ষিণ আনন্দামান জেলা পরিষদের একজন নির্বাচিত সদস্য। পোর্টব্লেয়ারে যার অফিস। না এখানে কোন বিডিও অফিস নেই। বুঝতে পারলাম। এখানে ত্রি-স্তর নয় দ্বি-স্তরের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। একটি সরকারী হাসপাতাল, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, জুনিয়র হাইস্কুল, প্রাইমারী স্কুল আছে কয়েকটা। লোকসংখ্যা আনুমানিক নয় হাজারের মতো। রয়েছে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা। অর্থাৎ আন্দামান-নিকোবর পরিবহন সংস্থার বাস যোগাযোগ ব্যবস্থা। অন্যান্য দ্বীপগুলি চেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতাও বেশী। গ্রামের নামগুলি এখানে আবার নীলের মতো রামায়ন থেকে নেওয়া নয়। সুন্দর শ্রতিমধুর নামগুলি যেমন, গোবিন্দ নগর, বিজয় নগর (কালা পাথর), শ্যামনগর, কৃষ্ণনগর, রাধানগর । 

উনার সঙ্গে গল্প করে আরেকটি বিশেষ বিষয় জানা গেলো। এখানকার এক এক দ্বীপে এমন বহু মানুষ আছেন যারা অন্য দ্বীপে যাননি কোন দিনও। বিয়ে-সাদীও এক দ্বীপের মধ্যেই হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে নীল আর হ্যাভলকের বাসিন্দাদের মধ্যে সমন্ধ হয়ে থাকে।

দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে বেলা ২টায় আমরা হ্যাভলকে পৌঁছলাম। জাহাজ থেকে নেমে আমাদের নামে প্লেকার্ড হাতে ব্যক্তির কাছে সত্যজিতের দেওয়া দ্বিতীয় খামটি দিলাম। ওনি আমাদের জন্য একেবারে বিচ সংলগ্ন হোটেল মুন লাইট-এ তিনটি রুম বুক করে রেখেছিলেন। হোটেলে উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বেলা সাড়ে ৩টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো রাধানগর বিচের উদ্দেশ্যে।

হ্যাভলক থেকে রাধানগর বিচের দূরত্ব আনুমানিক ১২ কি.মি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সাদা বালির স্বচ্ছ নীল সমুদ্র, এবং সমুদ্র তীরে ছায়া-সুনিবিড় সুন্দর বৃক্ষরাজির জন্য এশিয়ার মধ্যে সপ্তম সুন্দরতম বিচ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে রাধানগর। আঁকাবাঁকা পিচ ঢালা রাস্তায় লোকালয়ের মাঝখান দিয়ে নারকেল বাগানের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম বিচে। লোকজন কমই দেখলাম। এই বিচ স্নানের জন্য খ্যাতি রয়েছে। পর্যটকরা সাগরপাড়ে বেলাভূমিতে ঘোরাফেরা করে ছায়া শীতল গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন। রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। বসার বেঞ্চগুলি আস্ত গাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরী।

ক্রমে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। বহু পর্যটক বাসে করে এসে নামলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই নিস্তব্ধ সাগরপাড় কোলাহলে মুখরিত। সবাই স্নানের জন্য উন্মুখ। কে নেই তাতে, ভুরিওয়ালা পাঞ্জাবি, ঘোমটা দেওয়া অবাঙালি নারী, বৃদ্ধ থেকে নব দম্পতি সবাই যেন স্নানের প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে।

বিকেলের সূর্য লাল ওড়না জড়িয়ে সাগরের ঠিক মধ্যিখানে ক্রমশ নীচে নেমে আসছে। সমুদ্রের জলে আর সমুদ্র তটে ঢেউয়ে ভেজা বালিতে তারই বিম্ব গলিত সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে। উন্মুক্ত দিগন্ত বিস্তৃত সাগর। আন্দামানের সবচেয়ে মনোরম সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ এই সমুদ্রতট। ডান দিকের সবুজ চাদরে ঢাকা রেইন ফরেস্ট নেমে এসেছে সাগরের জলরাশির কাছাকাছি। বিচের পেছনেও একই গোত্রের বৃক্ষরাজি। ধীরে ধীরে সূর্য যেন নেমে এলো সাগরের বুকে। দূর দূরান্তে সাদা মেঘের আনাগোনা। আস্তে আস্তে সাগরের বুকে অতল গর্ভে তলিয়ে গেল সূর্যদেব। তার শেষ আভা মেঘের উপর বিম্বিত হতে দেখা গেল। সন্ধ্যা নেমে এলো সাগরের বুকে, পাড়ের বনপ্রান্তরে কোলাহল কমতে শুরু করেছে। আমরাও গাড়িতে করে হোটেলে ফিরলাম।

সময়টা ছিল অমাবশ্যার কাছাকাছি। তাই সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে মরা কাটাল শুরু হয়েছে। সাগরের জল স্ফীত হয়ে আমাদের হোটেলের সামনের রাস্তায় আছাড় খেয়ে ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ করে চলেছে। দূর দূরান্তে জাহাজগুলোয় আলো জ্বলে উঠেছে। যেন সাগরের বুকে ভাসমান আলোর মেলা। হোটেলের সামনের চেয়ারে বসে সে দৃশ্য দেখছি আমরা। রাতের খাবারের ডাক এলো। হোটেল থেকে জেটি হাঁটার দূরত্ব। ওখানেই এক রেস্টোরেন্টে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা। রাতের মেন্যুতে ছিল সামুদ্রিক মাছের কয়েকপদ।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি তখনও জোয়ার রয়েছে। দূরের জাহাজগুলোতে যাবার জন্য স্থানীয় ছেলেরা বড় বড় গামলাতে চড়ে বৈঠা বেয়ে চলেছে। অবাক করা দৃশ্য। অবশ্য সাগরের উত্তাল ঢেউ তখন ছিল না।

ওই রেস্টোরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে আবারও রাধানগর বিচে গেলাম। হ্যাভলকের রত্ন বলে এই বিচকে। শান্ত সাগরের পারে বনানীর স্নিগ্ধ ছায়াতলে বসে আজ আর এই রোদে জলে নামতে ইচ্ছা করেনি। এখান থেকে ফিরে নিজেদের উদ্যেগে গেলাম আরেক সুন্দরতম বিচ কালাপাত্থর দেখতে। (নিজেদের উদ্যেগ বলছি এই কারনে, এই বিচে ভ্রমণ করতে যাওয়ার বিষয়ে আমাদের ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে কোন চুক্তি ছিল না।) নারকেল বন, লোকালয় পেরিয়ে বনপথে কিছুদূর যাবার পর এই বিচ। পরিচ্ছন্ন ও নির্জনতার জন্য প্রসিদ্ধ। খুবই অল্প পর্যটক আসে এখানে। পেছনে রেইন-ফরেস্ট, সামনে বার-দরিয়া সবুজ জলরাশি। সুন্দর লাগলো শান্ত-স্নিগ্ধ এই সমুদ্র সৈকত। বিচের ডানপাশের পাহাড়ের পাথরের রঙ কালো। এখানে এই কালো পাথর পাওয়া যায় বলেই এর নাম কালাপাত্থর।

অনেক্ষণ সাগর জলে পা ভিজিয়ে ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পাকা রাস্তার ধারে খড়ের চালা ঘরে বসে আছি। পাশে ছোট ছোট ছেলেরা লুডু খলছিল তাই দেখছি। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন মহিলা পুলিশ। কখন এসেছে বুঝতেই পারিনি। ব্যাজএ বাংলায় লেখা, 'আ: নি: পু:' আর নাম রয়েছে অনিতা মন্ডল। কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, আ: নি: পু: মানে! তিনি বললেন, 'আন্দামান ও নিকোবর পুলিশ'। তারপর অনেক কথা হলো। বললাম একা এই জঙ্গলে ডিউটি করা কি ভয়ের কারন নেই ? সে বলল, এখানে ক্রাইম খুব কমই হয়। যা দু'একটা হয় সে কোস্টাল বিষয় নিয়ে। চুরি-ছিনতাই এখানে ওসব নেই। শুনে ভাবলাম, উদ্বাস্তু বাঙালি প্রধান এসব দ্বীপ, তবুও কোন চুরি-চামারি, ঝগড়া-বিবাদ নেই! কথাটা শুনে খুবই ভালো লাগলো। তারপর তার স্কুটিতে একটি বাচ্চা ছেলেকে চাপিয়ে গভীর জঙ্গলের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রচণ্ড গরমে কাবু; তাই ডাব খেয়ে আবার জলের কাছে দাঁড়ালাম। ঢেউ এসে এবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই উত্তাল হচ্ছে সাগর। একটা বিচিত্র বিষয় লক্ষ্য করলাম এখানে। জলের রঙ যেন পরতে পরতে আলাদা। একদম পাড়ে বালির সঙ্গে ঢেউয়ের আঘাতের জন্য ঘোলাটে রঙ, তার পরের পরতে কালো, তারপর নীল, তারপর সবুজ জলরাশি।

কালাপাত্থর থেকে ফেরার পথে আরেকটা বিচে গেলাম। খুবই বড় বিচ এটা। নাম গোবিন্দনগর বিচ। তখন ভাটা শুরু হয়েছে। জল নেমে গিয়েছে অনেকটা। পাড়ে এখানেও প্রচুর গাছপালা। একটা পার্কের মতো আছে। সাগর দূরে চলে যাওয়ায় আমরা কাদা-বালিতেই নেমে গেলাম। সুন্দর ঝিনুক আর বড় আকারের কড়ি কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল অনেকেই। এই বিচ থেকে সাধারণত মৎস্যজীবীদের কাঠের নৌকা আর ফিসিং বোট চলাচল করে। 

এখানে কথা হয় রঞ্জন মন্ডল নামের স্থানীয় এক বোট মালিকের সঙ্গে। কথা হয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন থেকে বর্তমান অবস্থা নিয়ে। এখানে সমুদ্রতট থেকই ২০০ মিটারের মধ্যে সব বাড়ি-ঘর উদ্বাস্তু মৎস্যজীবীদের। এখানকার মানুষের আচার ব্যবহার সুন্দর। রঞ্জন বাবু বললো, স্যার ওই তো পাড়ের বাড়িটাই আমার। চা খেয়ে যাবেন, চলুন না। সময় হবে না বলে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। দুপুরের খাবার সেরে আমরা তৈরী হয়ে নিলাম আন্দামানে ফেরার জন্য। এখানকার গাইড ফাস্ট ট্রিপের টিকিট ম্যানেজ করতে পারেনি তাই সেকেন্ড ট্রিপের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। হোটেল ছেড়ে এসে জাহাজ ঘাটে নিজেদের মধ্যে আড্ডা আর চা, ডাব খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা। তবে এখানে স্কুবা ড্রাইভের ব্যবস্থা আছে, আমাদের প্যাকেজে ছিল না তাই আমরা করতে পারিনি। হয়তো একটু চেষ্টা করলে করা যেতেও পারতো। এলিফেন্টা দ্বীপে, এখান থেকে বোটে নিয়ে যাচ্ছে। মাস্ক লাগিয়ে জলের নীচের প্রাণিজগৎ দেখার ব্যবস্থা। যাবার আগে শারীরিক সক্ষমতার একটা পরীক্ষা নেয় না কি ওরা। আমরা দু'জন মানে আমি ও ভদ্র আগেই বাদ পড়বো এটা জানাই ছিল। আর মেয়েরাও সাগরে জলের নিচে নামার সাহস পায় নি।

সন্ধ্যায় আমাদের জাহাজ ঘাটে পৌছালো। আমরা হ্যাভলককে বিদায় জানালাম। আমাদের রাতের অন্ধকারে সমুদ্রযাত্রা শুরু হলো। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। চলাচলের পথ ডিমারকেশন করার জন্য আলোর ব্যবস্থা কোথাও চোখে পড়ল। আবার আড়াই ঘন্টার জার্নি করে আমরা রাত ৮টায় পোর্টব্লেয়ারে পৌছলাম। সত্যজিৎ আর ডেভিড আমাদের হোটেলে পৌছে দিলো। তারপর রুমে হাত-পা ছড়িয়ে জম্পেশ গল্প হলো ওদের সঙ্গে।

সত্যজিৎ জানালো, পরের দিন জড়োয়া ভিউ আর বাড়াটাঙ আইল্যান্ডে লাইম স্টোন কেভ আমাদের গন্তব্য। 'স্যার; সকাল ৪টার মধ্যে বের হতেই হবে কিন্তু। তা না হলে কিছুই দেখতে পাবেন না। সেভাবে সবাই রেডি থাকবেন।' ডিনার শেষে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ডেভিড আবার মনে করিয়ে দিলো, 'কাল ঠিক সুবা চার বাজকে হাম আজায়েগা। আপলোক রেডি থাকিয়ে স্যার।' চলবে...

মন্তব্য করুন: