• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

ছুটির ফাঁকে

দ্বীপান্তরের আন্দামান (শেষ পর্ব)

অজিত কুমার দত্ত

 প্রকাশিত: ০৩:২৬, ৫ আগস্ট ২০১৮

দ্বীপান্তরের আন্দামান (শেষ পর্ব)

আমাদের আন্দামান ভ্রমণ প্রায় শেষের দিকে। দেখা হলো অনেক, আবার বাকিও থাকল অনেক কিছু। পোর্টব্লেয়ার দ্বীপ সংলগ্ল রস আইল্যান্ড দেখা বাকি ছিল। এক লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য কয়েকদিন পোর্টব্লেয়ার-রস আইল্যান্ডে পারাপার বন্ধ ছিল। তাই রস আইল্যান্ড ছিল একপ্রকার পর্যটক বিচ্ছিন্ন। মেরিনা বীচ সংলগ্ন জেটি হতে এই দ্বীপের দূরত্ব জলসীমায় আনুমানিক তিন কিলোমিটার।

রস আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য পোর্টব্লেয়ার থেকে সরকারি লঞ্চ রয়েছে। প্রতিটি লঞ্চ ৩০ থেকে ৪০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে রওনা দিলাম আমরা। সত্যজিৎ ও ডেভিড মেরিনা বীচ জেটিতে আমাদের লঞ্চে তুলে দিলো। মাত্র ২০ মিনিটে জার্নি শেষে পৌঁছে গেলাম আন্দামানে ইংরেজদের প্রথম ক্যাপিটাল রস আইল্যান্ড। সত্যিই দারুণ মনোরম এই দ্বীপ। দ্বীপে জুড়ে সারি সারি নারকেল গাছ। প্রতিটি গাছে নম্বর দেওয়া আছে। আর নোটিশ বোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রয়েছে নারকেল নিয়ে গেলে আড়াইশ' টাকা জরিমানা।

যাক, আমাদের সঙ্গে আরো যারা এসেছিল তারা সবাই যে যার মতো টিম নিয়ে ঘোরাফেরা শুরু করে দিয়েছে। ট্যুরিস্টদের বসার জন্য যাত্রী ছাউনি রয়েছে সাগরের তীর ঘেঁষে। কোন বেলাভূমি এই দ্বীপে নেই। মাটির শেষেই সাগরের জল ঢেউ খেলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরমেও শীতল সমুদ্রের প্রাণ জুড়ানো হওয়া স্বস্তি এনে দিচ্ছিল।

এটাই প্রথমে ইংরেজদের হোম টাউন ছিল। এজন্যই হয়তো এই দ্বীপে আর অন্য কোন বসতি ছিল না। জনপ্রাণী শূন্য এই দ্বীপে ইংরেজরা বসবাস শুরু করেছিল। এখান থেকেই তারা এই দ্বীপপুঞ্জে কর্তৃত্ব চালাতো। কারন অবশ্য ছিল একটা। তা হলো অন্যান্য দ্বীপগুলিতে জারোয়াদের উৎপাত ছিল। ওদের বিষাক্ত অদৃশ্য তীর ইংরেজদের নাজেহাল করে তুলতো। এখানে প্রথম বসতিস্থাপনের আরো দু'টা কারন মনে হয়। চারদিকে সাগর বেষ্টিত হওয়ায় সুরক্ষার দিক থেকে নিরুপদ্রব ছিল। আর সমুদ্রের শীতল হওয়া, ইংরেজদের বাতানুকুল পরিবেশ এনে দিতো।

আমরা ঘুরে ঘুরে পুরো দ্বীপ দেখলাম। নারকেল গাছে পরিপূর্ণ এই দ্বীপ । এখানে একটি গির্জা,একটি মন্দির, বিস্কুট কারখানা, ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠ, মিনি পাওয়ার হাউস এবং একটি পার্ক ছিল। ছিল বসত বাড়ীও। এখন সবই ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। যদিও পার্কটি আছে এখনো। তাতে কয়েকটি ময়ূর-ময়ূরী, চিত্রল হরিণ আর কিছু খরগোশ রয়েছে।

সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দ্বীপটির দৈর্ঘ বেশী হলে এক কিলোমিটার ও প্রস্থ পাঁচশ' মিটারের কিছু বেশী। সামনের দিকটা তুলনায় নিচু হলেও পিছনের দিকটা অনেক উচু। প্রায় দেড়শ' সিঁড়ি ভেঙে সাগরের জলের কাছে যাওয়া যায়। পিছনে উত্তাল সমুদ্র, নীল জল দিগন্ত প্রসারিত আকাশের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। কি অপূর্ব দৃশ্য, না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। পশ্চিম দিকেও তাই তবে। এ দিকটা একটু ঢালু থাকায় সাগরে পুকুরের মতোই ঘাট বাঁধানো রয়েছে। এখানেও লাইট এন্ড সাউন্ড শো'য়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন বন্ধ ছিল। শুনলাম প্রথমে এখানেই ছোট আকারে জেলখানা ছিল দ্বীপান্তরিত কয়েদিদের জন্য।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য যেন ঢেলে দিয়েছে এখানে। ঘোরার সময় দেখা হল বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে আগত ইছাহাক শিকদার, ঢাকা ভারত সেবাশ্রমের কয়েকজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে। আরেকজন মি. সামশেদ ক্রালোয়ারী'র সঙ্গে। তিনি কাশ্মীর থেকে স্বপরিবারে এসেছেন। কাশ্মীরে আকাশবাণীতে কাজ করেন। বেশ অমায়িক মানুষ। গল্প হলো কাশ্মীর নিয়ে। ঠিকানা দিলেন বেড়াতে যাবার জন্য।

ফেরার পথে যাত্রী ছাউনিতে লঞ্চের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। একজন সাগরের জলে কিছু একটা ছুড়ে দিলো। দেখলাম নানা রঙের মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে উঠেছে। আমাদের কাছে বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। জেটিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি বিস্কুট নিচে ছুড়ে দেওয়া হলো। আর যায় কোথায়, উপরের স্তরে ছোট ছোট মাছ আর তার নিচে বেশ বড় আকারের মাছের ঝাঁক দেখা গেলো।

বিকেল চারটায় পারাপার বন্ধ হয়ে যায় তাই আমরা ফেরার লঞ্চে উঠে বসলাম মেরিনা বীচের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে মাউন্ট আবু'র দূরত্ব কমই মনে হলো। লঞ্চ থেকেই তার দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আমরা মেরিনা বীচে পৌঁছে গেলাম। আবার সন্ধ্যা অবধি কাটিয়ে দিলাম এখানেই।

২৫ তারিখ স্পাইসজেটে আমাদের ফিরতি টিকিট কাটা আছে। বিদায়ের ঘন্টা বাজছে তাই মনটা খারাপ লাগছে। কিন্তু এখনো চিড়িয়া টাপু যাওয়া হয়নি। তাই সকাল সকাল তৈরি হয়ে চিড়িয়া টাপুর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভোরের ফাঁকা রাস্তা আর ডেভিট হল চালক। উড়িয়ে নিয়ে এল এই সমুদ্র উপকূলে। বলতে গেলে পোর্টব্লেয়ার দ্বীপের চারদিকেই ঘোরা হয়ে গেল আমাদের। সুন্দর জায়গা। এখানে সুনামির চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। বিরাট বিরাট গাছ উপরে পরে আছে সাগরের জলে। একটু দূরেই এসএসবি ক্যাম্প রয়েছে। এখান থেকেও মায়ানমায়ারের জলসীমা খুব কাছেই। আমরা কিছুক্ষন থেকে ছবি তোলে ফেরার উদ্যোগ নিলাম।

পথে মুষল ধারে বৃষ্টি। রাস্তার ধারে এক গ্রামপঞ্চায়েত অফিস দেখে দাঁড়ালাম। নিজে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত বিভাগের অন্তর্গত একজন কর্মচারী হিসাবে এখানকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবার একটা সুপ্ত বাসনা ছিলো। অফিসে গিয়ে পঞ্চায়েত সচিবকে নিজেদের পরিচয় দিলে সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। সে বাংলাভাষী নয়, তাই ইংরেজিতেই বললাম আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কত কোটি টাকা একেকটি গ্রাম পঞ্চায়েতে বরাদ্দ হয়। কি তার কর্মী কাঠামো। ওর কাছে থেকে ওখানকার অবস্থা জেনে মনে হলো, আমরা কত এগিয়ে আছি। সচিব ওখানে পুরোপুরি সরকারী কর্মচারী হলেও স্টাফ প্যাটার্ন আমাদের মতো নয়। মাত্র তিন জন কর্মচারী ওরা। কাজ বলতে পানীয় জল, এমুনাইজেশন, আর কারো বাড়ি যাওয়ার কনক্রিট রাস্তা বানানো। চা-বিস্কুট খেয়ে মনে হল আমাদের এখানে কোন গ্রামপঞ্চায়েত অফিসেই বসে আছি। ভালো লাগলো আলাপ করে। ফেরার তারা আছে। তাই ফটো নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। ঘরে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম। লাগেজ আগেই রেডি ছিল। এবার এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম। ডেভিড আমাদের সঙ্গে। সব ঠিক ঠাক নামিয়ে ডেভিডকে বিদায় জানাতে গিয়ে সত্যি মন খারাপ হয়ে গেল। কারন সেই ছিল এখানে আমাদের ছায়া সঙ্গী।

এবার ঘরে ফেরার পালা। সায়োনারা আন্দামান! #

মন্তব্য করুন: