• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪

ফিচার

তিস্তার চুক্তি কবে ?

আসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট সংবাদদাতা

 প্রকাশিত: ০৮:৫২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

তিস্তার চুক্তি কবে ?

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সাথে সফলতা নিয়ে সব চুক্তি করে বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করলেও আজ কাল করে বছরের পর বছর পার হচ্ছে কিন্তু তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। পানির অভাবে তিস্তা র‌্যারাজ সেচ প্রকল্প থেকে রংপুর-দিনাজপুরকে বাদ দেয়া হয়েছে। তারপরও পানি সংকট কাটছে না। আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে তিস্তার পানি চুক্তির জন্য ? এ ভাবে ক্ষোভের সাথে কথা গুলো বললেন, তিস্তা পাড়ের কৃষক ও স্কুল শিক্ষক সফিয়ার রহমান।

স্বল্প পানি প্রবাহের ওপর ভর করে চলতি খরিপ-১ মৌসুমে (বোরো) লালমনিরহাট জেলায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তবে এবার রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ড এলাকাকে সেচ সুবিধা থেকে বাদ রেখে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নিভর যোগ্য সূত্র মতে, সম্ভাবনা জাগিয়েও বারবার থেমে থাকছে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি। চুক্তি না থাকায় বিগত সময়ের মতো এবারও চলতি মৌসুমে নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তিস্তা নদী ধু-ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪ সালে এই মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেচ দেয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ প্রদান করা হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে।

বোরো আবাদের মোক্ষম সময়ে কমান্ড এলাকায় কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা পড়েছে বিপাকে। গত কয়েকদিন আগেও নদীর পানিপ্রবাহ প্রায় আড়াই হাজার কিউসেক থাকলেও তা রোববার মাত্র ৮০০ কিউসেকে নেমে এসেছে বলে জানা যায়।

তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ দিন দিন কমতে থাকায় এবার মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারী সদর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে নীলফামারী সদরে ৮০০ হেক্টর, ডিমলা উপজেলার ৫ হাজার হেক্টর, জলঢাকা উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ২০০ হেক্টর। তবে উজানের প্রবাাহ পাওয়া গেছে। সেক্ষেত্রে সেচের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে জানা গেছে।

কৃষকরা বলছেন, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। জমি তৈরি থেকে চারা রোপণ এবং আবাদ চলমান পর্যন্ত প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এখন তিস্তায় পানি নেই। তাই সেচ প্রকল্পের সেচের আশা বাদ দিয়ে নিজেরা সেচযন্ত্র (স্যালো) ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে।

ডিমলা উপজেলার নাউতরা ইউনিয়নের সাতজান গ্রামে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রধান খালের পাশের কৃষক বেলাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, উজানের প্রবাহ না থাকায় তিস্তা সেচ প্রকল্প আগের মতো পানি দিতে পারে না। ফলে নিজস্ব সেচযন্ত্র দিয়ে এক বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করতে খরচ হবে ৫ হাজার টাকা।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বহু আলোচিত এ চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। চুক্তিটি না হওয়ায় বাংলাদেশের হতাশার কথা দিল্লিকে বেশ স্পষ্টই জানয়ে দেয়া হয় সে সময়। হতাশা প্রকাশ করেন মনমোহন সিংও।

মমতাকে রাজি করাতে এরপর দিল্লির পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়। দীপু মনি নিজেও কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিস্তা চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে অনড় থাকেন মমতা। পরে মমতা কিছুটা নমনীয় হয়েছে।

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রেক্ষিতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতিও নেয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি।

সুত্র মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির জটিলতার ফলে পানি সংকটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক প্রভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেজ্ঞরা। শুষ্ক মৌসুমে তিস্ত নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের মানুষের অন্যতম প্রধান জীবিকা কৃষিকাজে পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। পরিবেশগত প্রভাবের কারণে এ পরিস্থিতি দিন-দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ার প্রভাব থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে ন্যায়সঙ্গত এবং সুষম পানিবণ্টন চুক্তিতে সই ও তা কার্যকর করার জন্য ভারতকে আহ্বান জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ এবং দেশের মানুষ। যে আহ্বান গত কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশ ভারতকে করে আসছে। কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চুপ ভারত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তা পনিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন না হওয়ার কারণে বড় ধরনের প্রভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সেই প্রভাব দিন-দিন বাড়ছে। জরুরি ভিত্তিতে এ পানিবণ্টন চুক্তি হওয়া উচিত। কারণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশের অর্থনীতি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। পানি ঘাটতির জন্য তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় কৃষি জমিতে পর্যাপ্ত সেচ দেওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ভারতে তিস্তা নদীর মুখে বাঁধের কারণে তিস্তার পানি ভারতের বিভিন্ন অংশে চলে যাচ্ছে। পনিবণ্টন চুক্তি না থাকায় কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না ভারত।

অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা আশা করি বাংলাদেশ সরকার তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব শিগগিরই ভারত সফর করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চুক্তির বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। এছাড়া কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় পানি বণ্টনচুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. আতিয়ার রহমান বলেন, তিস্তা নদীতে পানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ অংশে পরিবেশগত ক্ষতিসাধন হচ্ছে। এমনকি সেখানে ফসল চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। তিস্তা নদীতে পানি প্রভাব ঠিক রাখতে ৩ হাজার কিউসেক পানি দরকার বলেও জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এ কিউ এম মাহমুব বলেন, যদি নদীতে পানি না থাকে, তবে এটিকে নদী বলা যায় না। পানিশূন্য নদী শুধু ফসলের ওপরই নয়, পরিবেশের ওপরও প্রভাব ফেলে। নদীর পানির মধ্যদিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে। ফসল ও বৃক্ষরাজির প্রাণ হলো নদী। এ অঞ্চলের বন্যা এবং খরা মোকাবেলা করতে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং চীনের পানি ব্যবস্থাপনা নীতি সমন্বয় করা উচিত বলেও মন্তব্য তিনি।

সূত্র বলছে, তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৮০০ কিউসেক। কিছুদিন আগেও তিস্তা ব্যারেজে পানির স্তরের পরিসীমা ১০০০ থেকে ১২০০ কিউসেক ছিল। বর্তমানে তিস্তায় পানি সংকটের কারণে বোরো আবাদি কৃষকরা ব্যাপক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে দারিদ্রপীড়িত উত্তরাঞ্চলের মানুষের রুটি ও রুজির বিষয় বিবেচনা এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সুদৃঢ় করতে জরুরি ভিত্তিতে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি সই এবং তা পরিপূর্ণভাবে কার্যকরের দাবি জানিয়েছে দেশের বিশেষজ্ঞ মহল ও সাধারণ মানুষ।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী বলেন, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে রোববার থেকে সেচ প্রদান শুরু করা হয়। তবে শুরুতে সেচ দেয়া হয়েছে জলঢাকা উপজেলার হরিশচন্দ্র পাট এলাকায়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সেচ প্রদানের চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, উজানের প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় তিস্তা নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের কমান্ড এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কমবে, বাড়বে এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তারপরও তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন।

জানুয়ারি ২৯, ২০১৭

মন্তব্য করুন: