• ঢাকা

  •  শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

ভিনদেশ

একটি খুনের শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনায় বেরিয়ে এলো আরও দুই খুনের তথ্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

 প্রকাশিত: ১২:২৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একটি খুনের শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনায় বেরিয়ে এলো আরও দুই খুনের তথ্য

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার আকাঙ্ক্ষা শর্মা খুনের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর মোড় নিয়েছে। আকাঙ্ক্ষা খুনের আগে বাবা-মাকেও খুন করে পুঁতে ফেলে উদয়ন।  রাজ্য পুলিশের জেরায় উদয়ন জানিয়েছে যে শুধু আকাঙ্ক্ষা নয়, তার আগে নিজের বাবা-মাকেও খুন করেছিল সে। ছত্তিসগড়ের রায়পুরে তাদের খুন করে দেহ মাটিচাপা দেয় উদয়ন।

ফেসবুকে আলাপ। তারপর প্রেম। তারপর লিভ ইন। তারপর গলা টিপে খুন। তারপর প্রেমিকার দেহ ট্রাঙ্কে ভরে ১৪ বস্তা সিমেন্ট গুলে বাড়ির একটি ঘরেই বানিয়ে ফেলে পূঁজার বেদি। সেই বেদিতে ঠাকুর-দেবতার ছবি বসিয়ে শুরু হয় পুজা। শুক্রবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) সেই বেদি খুঁড়ে আকাঙ্ক্ষা শর্মার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ জেরা করে জানতে পেরেছে, ফ্রাঙ্ক ডেরাবন্ট পরিচালিত আমেরিকান ধারাবাহিক ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ দেখেই প্রেমিকাকে খুনের ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরি করেছিল প্রেমিক উদয়ন দাস।

বাঁকুড়ার বাসিন্দা আকাঙ্ক্ষা শর্মা সাত মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি করতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বের হয় আকাঙ্খা। তারপর থেকে কোনো খোঁজ নেই তার। তবে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল সে। কিন্তু কিছুদিন পর সেই যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়।

গত ৫ জানুয়ারি বাঁকুড়া সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন আকাঙ্ক্ষার বাবা ইউবিআই ব্যাঙ্কের চিফ ম্যানেজার শিবেন্দ্রকুমার শর্মা। তাদের আসল বাড়ি পাটনায়৷  চাকরির সুবাদে বাঁকুড়ায় বসবাস করেন। জানা যায়, উদয়ন বেশ কয়েক বার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেখা করতে বাঁকুড়াতেও এসেছিল।

আকাঙ্খার নিখোঁজ তদন্ত নয়া মোড় নেয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ভোপালের সাকেতনগর আরসি কলোনির বাসিন্দা উদয়ন দাস নামে এক যুবকের বাড়ির একটি ঘরের কবর খুড়ে উদ্ধার হয় নিখোঁজ আকাঙ্খার দেহ। শুক্রবার সাকেতনগর থানার এসএইচও দীনেশ চৌহান বলেন, ‘উদয়নকে জেরা করে জানা গেছে, প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে আকাঙ্খার যোগাযোগ রাখার বিষয়টি পছন্দ ছিল না তার। মাঝেমধ্যেই প্রাক্তন প্রেমিক আকাঙ্খাকে এসএমএস পাঠাতো। বারবার বারণ সত্ত্বেও সেটা বন্ধ হয়নি। এর পরই প্রেমিকা আকাঙ্খাকে খুন করবে বলে ঠিক করে উদয়ন।’

কীভাবে আকাঙ্খাকে খুন করে দেহ লোপাট করা হবে, সেই ছক কষতে শুরু করে সে। দীনেশ জানান, ইংরেজি চ্যানেলে দেখানো ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ ধারাবাহিকের একটি এপিসোড দেখে খুনের ছক কষে উদয়ন।

ভোপাল পুলিশ জানায়, খুনের কয়েকদিন আগের থেকে উদয়ন বাড়িতে মজুত করতে থাকে বস্তা-বস্তা সিমেন্ট। অভিজাত এলাকায় দোতলা ওই বিলাসবহুল বাড়ির উপরতলায় একাই থাকতো সে। আকাঙ্খা বাঁকুড়ার বাড়ি ছেড়ে আসার পর উদয়নের সঙ্গে ওই বাড়িতে লিভ-ইন করতো। নীচের ঘরগুলি ভাড়া দেওয়া ছিল।

ভাড়াটিয়াদের উদয়ন জানিয়েছিল, ঘরে ঠাকুরের একটি আসন তৈরি করা হচ্ছে। সেই জন্যই সিমেন্ট আনা হয়েছে। কিনে আনে একটি পাঁচ ফুট মাপের টিনের ট্রাঙ্ক। সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর ১৫ জুলাই আসরে নামে উদয়ন।

ওইদিন ভোর সাড়ে ৪টা থেকে ৫টা নাগাদ বেডরুমে ঘুমাচ্ছিলেন আকাঙ্খা। ঘুমন্ত অবস্থায় তার পেটের উপর বসে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে খুন করে উদয়ন। এর পর একটি বস্তায় দেহটি ভরে ট্রাঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।

দুপুর আড়াইটা নাগাদ স্থানীয় এক নির্মাণকর্মীকে ডেকে এনে সিমেন্ট গুলে দিতে বলে উদয়ন। তার নির্দেশে বাড়ির নীচের একটি অংশে কয়েক বস্তা সিমেন্টের গোলা তৈরি করে দেয় ওই শ্রমিক। সেই সিমেন্টের গোলা দিয়ে দেহসমেত ট্রাঙ্কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দু’দিন এ ভাবেই বেডরুমের পাশে একটি ঘরে ট্রাঙ্কটিকে লুকিয়ে রেখে দেয় সে।

দীনেশ চৌহান জানান, পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করায় আরও একটি বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে আসে উদয়ন। ওই ট্রাঙ্কের ভিতরে দেহসমেত আগের ট্রাঙ্কটিকে রেখে আরও সিমেন্ট গোলা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোট ১৪ বস্তা সিমেন্ট ব্যবহার করা হয় এই কাজে। এর পর ওইদিনই ওই ঘরের ভিতরের গর্ত খুঁড়ে ঢালাই করে একটি বেদি বানায় সে। বেদির উপরে বসানো হয় মার্বেল। এই বেদিটি তৈরির সময়ও কোন মিস্ত্রিকে বাড়িতে ঘেঁষতে দেয়নি উদয়ন।

পুলিশ জানতে পেরেছে, মিস্ত্রিকে দিয়ে সিমেন্ট মশলা বানিয়ে নিয়ে এসে নিজেই বেদিটি ঢালাই করে উদয়ন। মার্বেল দিয়ে ফিনিশিং টাচ দেওয়ার সময় মিস্ত্রিকে ডাকে সে। এর পর ঠাকুর-দেবতার মূর্তি বসিয়ে বেদিটিকে উপাসনাস্থল বানিয়ে ফেলে। শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করে আকাঙ্খার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

বাঁকুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, ‘উদয়নের বাড়ি থেকে আকাঙ্খার ব্যাগ, জামাকাপড় ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো দেখে আমাদের মনে হয়েছে মৃতদেহটি আকাঙ্খারই। আকাঙ্খার দাদা আয়ুষ জিনিসগুলি চিহ্নিত করেছে। দেহটিও চিহ্নিত করেছে তার দাদা। নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে।’

বেদিটির সামনেই কালো রঙের একটি দঁড়ি ফাঁস দেওয়া অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদয়ন নিজে আত্মহত্যার চেষ্টার করছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।

আরশি কলোনির ‘ইন্দ্রাণী’ নামে এই বাড়িটির চারিদিকে নোংরা, আবর্জনার স্তুপ। যত্রতত্র পড়ে রয়েছে খাবার। দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন কোনও লোকজনের আনাগোনা নেই। দরজা, জানালা সবই বন্ধ। এমনকী অনেক জায়গায় ফাঁকফোকর বন্ধ করা হয়েছে সেলোটেপ দিয়ে। পড়ে রয়েছে হাজার হাজার সিগেরেটের টুকরো।

ভোপাল পুলিশ জানায়, দিল্লির একটি আইটিআই কলেজ থেকে পাশ করলেও তেমন কোনো কাজকর্ম করত না উদয়ন। বাবা বি দাস রেলের জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। চাকরি থেকে অবসরের পর তিনি ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। কয়েক বছর আগে 'মৃত্যু' হয়েছে তার বাবার। উদয়নের মা ইন্দ্রাণীদেবীও ভোপালের সংস্কৃত দপ্তরে উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন। একমাত্র ছেলে হওয়ায় বাবা-মায়ের গচ্ছিত টাকা ও ভাড়ার টাকা দিয়েই খরচ চলতো তার। ব্যবহার করতো দামি গাড়ি। তবে তার মায়ের অনুপস্থিতিও সন্দেহ বাড়িয়েছে তদন্তকারীদের।

এর আগে পুলিশের কাছে জেরায় ওই যুবক জানিয়েছিল, অবসরের পর তার মা আমেরিকায় চলে গেছেন। তবে আমেরিকার কোথায় তিনি থাকেন সে সম্পর্কে অবশ্য পুলিশকে কোনও তথ্য দিতে পারেনি। তার দাবি, গত কয়েকমাস মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

জেরায় সে আরও জানিয়েছে, আগে তার বিয়ে হয়েছিল। জার্মানিতে একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার স্ত্রীর।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছে, লোকের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতো না উদয়ন। এমনকী, তার কীর্তি যাতে ফাঁস না হয়, তাই কাজের লোককেও ছাড়িয়ে দিয়েছিল সে। নিজেই খাবার কিনে এনে খাওয়া-দাওয়া করতো৷

তবে তার বয়ানে কতটা সত্যতা আছে তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

শনিবার (০৪ জানুয়ারি) নিজের বাবা-মাকেও খুন করে বাগানে পুঁতে ফেলেছিল বলে জানিয়েছে সে। ঘটনা খতিয়ে দেখতে উদয়নকে নিয়ে রায়পুর যাচ্ছে রাজ্য পুলিশের একটি দল। সেখানেই ঠিক কোথায় মৃতদেহ দুটি পুঁতে রাখা হয়েছিল, তা দেখে দেহের অবশিষ্টাংশ উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।

ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৭

মন্তব্য করুন: