• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

ফিচার

চাঁদ দেখার বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির পথ কী?

সৈয়্যেদ শাহ নূরে পারভেজ

 প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ৮ জুলাই ২০১৭

চাঁদ দেখার বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির পথ কী?

পরম করণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি; যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করে বিবেক ও জ্ঞান দান করেছেন।

আমরা ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ইসলামের হুকুম-আহকাম সঠিকভাবে পালন করার ইচ্ছা সবারই আছে। কোরআন-হাদীস ও অন্যান্য বিষয়ে আমাদের জ্ঞান নেই বলেই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই ধর্মীয় হুকুম-আহকাম পালনের জন্য নির্ভর করতে হয় আলেম-ওলামাদের উপর। তাদের দেওয়া সিদ্ধান্তই এ দেশের মানুষ সাদরে গ্রহণ করে সেই মোতাবেক ধর্মীয় সকল আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।

উপরের ভূমিকাটুকু টানা হলো এ জন্য যে, আমাদের দেশে ঈদ এবং রোজা নিয়ে প্রায়শই বেশ কিছু মতের পার্থক্য হয়ে থাকে। এই মতের পার্থক্য দূর করে সকল মুসলমানের একমত হওয়া দরকার। তাই কোরআন এবং সহীহ-হাদীসের আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব এ দেশের তথা সমস্ত মুসলিম জাহানের বুজুর্গগণ ও আলেম-ওলামাদের।

তাই আমরা জানতে চাই, আমাদের দেশে ১৯৯৮ সালের ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল- যেমন অনেক এলাকায় একদিন আগে ঈদ পালন করা হয়েছে, আবার অনেকে তার পরের দিন ঈদ পালন করেছেন। এই বৈষম্যের সমাধান কি হবে না?

ঐ ঈদুল ফিতরের রাত ১০টায় চাঁদ দেখার খবর প্রচারিত হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অনেক মুসলমান সেই খবর পাননি, এমনকি তারা চাঁদও দেখেননি। তাই তারা রাতে তারাবিহ নামাজ পড়েছেন এবং ভোররাতে সেহরি খেয়ে রোজা রেখেছেন এবং ঈদের দিন বেলা ১০টা পর্যন্ত রোজা অবস্থায় থাকার পর জানতে পারলেন যে, সেদিন ঈদের দিন এবং তারা ঈদের দিনের প্রায় অর্ধেক দিনই রোজা রেখেছিলেন। ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম-এই ভেবে তাদের ভেতের ভয়ের সঞ্চার হয় এবং মনে মনে দোষারূপ করতে থাকেন। যাদের ভুলের জন্য তারা এই হারাম রোজা পালন করেছেন বা পালন করতে যাচ্ছেন সে কারণে তাদের যদি হারাম রোজা হয়ে থাকে তা হলে তার জন্য দায়ী কে হবে?

আল্লাহপাক আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর আমল থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আমল পর্যন্ত সকল বান্দাদের সঠিক নিয়ম-কানুন মানার হুকুম দিয়েছেন। আর ঐ নিয়মসমূহের বেশিরভাগই নির্দিষ্ট সময় দিন বা মাসের সাথে সম্পৃৃক্ত রয়েছে। তাই আল্লাহ নির্দেশিত নির্দিষ্ট সময়ে, দিনে বা মাসেই ইবাদত করা আমাদের জন্য ফরজ। নির্দিষ্ট করা ইবাদতসমূহ পালন করার সুবিধার্থে আল্লাহপাক আমাদেরকে চাঁদ ও সূর্যকে সময় গণনার মাধ্যম করে দিয়েছেন। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একমাত্র কলেমা ছাড়া বাকি চারটা স্তম্ভের ইবাদত চাঁদ ও সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল নামাজই সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত। আর বাকি তিনটি স্তম্ভই চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত। এর জন্যই সকল মুসলমানকে ইবাদতের জন্য চাঁদের উপরে বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়। তাই চাঁদকে গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।

আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, ‘চাঁদ ও সূর্যকে আমার আজ্ঞাধীন করিয়াছি।’ চাঁদ ও সূর্য আল্লাহর হুকুমের তামিলদার রয়েছে এবং এদের অনিয়মের কোনোই ক্ষমতা নেই। এরা আপন গতিতে কঠোর নিয়মেই কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে থাকে এতে কোনো সন্দেহ নেই। চাঁদ যদি নিজেদের নিয়মের একবিন্দু এদিক-সেদিক না করে থাকে তবে আমরা কেনো চাঁদ দেখা এবং চাঁদের সাথে স¤পৃক্ত ইবাদত নিয়ে এতো বিভ্রান্তে জড়িয়ে পড়ছি। রমজান মাস, এই পবিত্র মাস সম্পূর্ণই চাঁদের উপর নির্ভরশীল। আরবি মাসসমূহ হুজুর পাক (সা.) হতে স্বীকৃত যা চাঁদের শুরু অর্থাৎ প্রথম চাঁদ হতে চাঁদের শেষ বা অমাবস্যা পর্যন্ত ২৯ বা ৩০ দিনকে একমাস ধরা হয়।

এখানে আমাদের হিসেবের ব্যাপার, পৃথিবী থেকে প্রথম চাঁদ কবে দেখা গেল, ঐদিন থেকেই মাসের শুরু অর্থাৎ মাসের চান্দ্র মাসের এক তারিখ। তাই পৃথিবী থেকে প্রথম যেদিন রমজানের চাঁদ দেখা যাবে সেদিন থেকেই রমজান মাস শুরু হয়ে থাকে।

আমাদের প্রশ্ন এখানেই চাঁদ সম্পর্কিত ইবাদতের ক্ষেত্রে এতো মতভেদ কেনো? পবিত্র কোরআন এবং সহীহ হাদীস শরীফে সকল কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের মীমাংসা রয়েছে। আর সেই মীমাংসিত বিষয়টিকে জ্ঞানের আলোকে পর্যবেক্ষণ করে ব্যবহারিক জীবনে যারা প্রতিফলন ঘটাতে পারেন তারাই ইবাদতের ফলাফল তথা পূণ্য অর্জন করে থাকেন। তাই আমাদের জ্ঞান দ্বারা চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য-স্বভাব বিশ্লেষণ করে এদের সম্পর্কে অবহিত হওয়া দরকার। তবেই আমরা বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে পারি। রমজানের চাঁদ নিয়ে বহু যুগ আগে থেকেই আমরা বিভ্রান্তিতে রয়েছি। বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করে তদানুযায়ী ইবাদত করে আসছেন। ফলে ইবাদতের ক্ষেত্রেও মতভেদ-বিভ্রান্তি এবং ভিন্নতা আসছে যা ইসলাম মোটেই সমর্থন করে না। আর এই বিভ্রান্তির মূলে হলো ঐ চাঁদ।

চাঁদের জন্ম বা প্রথম চাঁদ, আর চাঁদের শেষ অর্থাৎ অমাবস্যা। এখানেই আমাদের জটিলতা। একটা বিষয় লক্ষ্য করি, চাঁদের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা নিয়ে কোনো মতভেদ হয় না, মতভেদ শুধু চাঁদের জন্ম বা প্রথম চাঁদ নিয়ে। আমরা ইংরেজি মাসগুলোকে লক্ষ্য করলে কি দেখতে পাই, যেমন ডিসেম্বরের শুরু হয় ৩০ নভেম্বর (আমাদের সময়) রাত ১২টা থেকে পরবর্তী ৩১ দিন শেষ হলে রাত ১২টা পর্যন্ত এ মাস চালু থাকে। পরবর্তী মাস শুরু হওয়ার আগে আর কোনো সময় থাকে না। ঠিক চান্দ্র মাসও তদরূপ অমাবস্যার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি মাস স্থায়ী হয় এবং পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই নতুন মাসের শুরু হয় অর্থাৎ চাঁদের আলোকিত অংশটুকু পৃথিবী পৃষ্ঠের বিপরীত দিকে থাকাকালীন সময়ে। পৃথিবীর কোথা থেকেও আর চাঁদ দেখা যায় না তখনই পূর্ণ অমাবস্যা। সাথে সাথে একটা মাসও পূর্ণ হয়ে যায়।

আবার পর মুহূর্ত থেকে চাঁদের আলোকিত অংশ পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে দৃশ্যমান হতে থাকে। আর চাঁদের আলোকিত অংশ পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে দৃশ্যমান হওয়ায় প্রথম মুহূর্তটি পৃথিবীর সকল অঞ্চল থেকে দেখা যায় না। পৃথিবীর যে অঞ্চলের দিকে চাঁদের অবস্থান ঐ অঞ্চলের লোকজনই প্রথম চাঁদ দেখতে পায়। অন্যন্য অঞ্চলের অধিবাসীরা পর্যায়ক্রমে একদিন বা দুদিন পরে চাঁদ যখন নিজ কক্ষপথে ঘূরতে ঘুরতে ঐ অঞ্চলে আসবে তখন দেখতে পাবে। এই বিলম্বিত সময়কেই পঞ্জিকায় প্রতিপদ ও দ্বিতীয়া হিসেব করে থাকে।

প্রশ্ন এখানেও, অমাবস্যাসহ ঐ দুদিন চাঁদ কি অদৃশ্যই থাকে? মোটেই না। চাঁদের বুকে প্রতিপদ বা দ্বিতীয়া বলে কোনো কিছু নেই। পৃথিবীর সকল মুসলমান একই সাথে প্রথম চাঁদ দেখতে পারবে না বিধায় নবী করিম (সা.) হাদীস শরীফে বর্ণনা করেছেন, ‘যদি কোনোক্রমেই চাঁদ দেখা না যায়, তবে চাঁদের হিসাব করতে হবে। কারণ, চাঁদ উঠার সময় আকাশে মেঘ থাকতে পারে, পৃথিবীর গোলত্বের কারণে চাঁদ দেখায় বিলম্ব হতে পারে। অথবা যখন চাঁদ উঠলো তখন হয়তো আকাশে সূর্য থাকার কারণে চাঁদ দেখা গেল না। এরূপ বিভিন্ন ওজরের কারণে চাঁদের হিসাব দ্বারা অথবা সাক্ষীর মাধ্যমে ফয়সালার নির্দেশ রয়েছে।

আমরা জানি, সূর্য কখনোই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয় না। চাঁদ ২৯ অথবা ৩০ দিন পর পর পৃথিবী থেকে কিছু সময়ের জন্য সম্পূর্ণ অদৃশ্য থাকে। এই অদৃশ্য হওয়াই চান্দ্র মাসের সমাপ্তি হয়। পরবর্তী মুহূর্তে চাঁদ দৃশ্যমান হওয়া থেকেই নতুন মাসের শুরু হয়। এই অদৃশ্য বা দৃশ্যমান হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর সকল স্থান হতে পরিলক্ষিত না হলেও চাঁদ কর্তৃক একটা মাসের শেষ ও নতুন মাসের সূচনার জানান দেয়। আর পৃথিবীর কোনো না কোনো মুসলমানের নিকট এটা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে এবং তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী চাঁদ না দেখতে পাওয়া মুসলমানগণ স্থানীয় ওয়াক্ত অনুযায়ী তারারির নামাজ আদায় করবেন, অথবা ঈদ উদযাপন করবেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, একমাত্র নামাজই সূর্যের সাথে সম্পর্কিত। তাই ওয়াক্তের হিসাব সূর্যের উপর আর মাসের হিসাব হয়ে থাকে চাঁদের উপরে। ঈদের বা রমজানের চাঁদ (প্রথম চাঁদ) পৃথিবীর সকল মুমলমান দেখতে পায় না। কোনো অঞ্চল থেকে চাঁদ দেখা গেলে পৃথিবীর গোলত্বের কারণে বিশ-পঞ্চাশ মাইল দূরের লোকজনই অনেক সময় চাঁদ দেখতে পান না। যারা চাঁদ দেখলেন না তারা কি এই বলবেন যে, আমরা নিজেদের চোখে চাঁদ দেখিনি, তাই আমরা ঈদ করবো না। এই রকম বলাটা কি ঠিক হবে?

যারা স্বচোখে চাঁদ দেখেছেন কেবল তাদেরই ঈদ করার অধিকার থাকে? আর যারা চাঁদ দেখেননি তাদের ঈদ করার অধিকার থাকে না? এই মতভেদের মীমাংসা হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে। যদি তিনজন মুসলমান সাক্ষী দেয় চাঁদ দেখা গিয়েছে, তবেই ঈদ উদযাপন বা রোজা রাখা যাবে। তবে যে সকল মুসলমান চাঁদ দেখলেন, বা তারা ঐ সাক্ষীর বলেই ঈদ বা রোজা পালন করতে পারবেন। এর পরও কি স্বচোখে চাঁদ দেখার প্রয়োজন আছে? নাকি সাক্ষীগণের স্বীকারোক্তির বলে  ঈদ বা রোজা পালন করা যাবে? তিনজন মুসলমানের সাক্ষীতেই যদি ঈদ পালন বা রোজা রাখা যায় তবে চাঁদ না দেখেও ঈদ পালন অথবা রোজা রাখা যেতে পারে। তাই যদি হয় তবে আরব দেশের লক্ষ-কোটি মুসলমান যেদিন চাঁদ দেখলেন এবং সাক্ষী দিলেন, সেই সাক্ষী কি আমাদের ঈদ উদযাপন বা রোজা রাখার জন্য যথেষ্ট নয়? তারাও তো মুসলমান।

আল্লাহ ও আল্লাহর হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের আজকের যুগ সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত আছেন এবং আগেও ছিলেন। হাদীস শরীফে বর্ণনা বা নির্দেশনাসমূহ কেবলমাত্র আরবদের জন্যই ছিল না, বরং পৃথিবীর সমগ্র উম্মতের জন্যই কিয়ামত পর্যন্ত প্রযোজ্য। কারণ, হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো গোত্র  বা জাতির রাসূল বা নবী নহেন। কিয়ামত পর্যন্ত তিনিই সমগ্র মানুষের শেষ নবী ও রাসূল। তাই নবী করিম (সা.)ই যখন বললেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো, ঈদ করো।’ তখন এ কথা শুধু আরবদের জন্যই বলেননি; বলেছেন তার সকল উম্মতের জন্যই। তাই কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত যে উম্মতই চাঁদ দেখে থাকে এবং সে যতদূর পর্যন্ত সাক্ষী পৌঁছাতে পারে ততদূর পর্যন্ত লোকজন চাঁদ না দেখে থাকলেও তারা ঐ সাক্ষীর বলেই রোজা রাখা বা ঈদ করতে পারবেন। এ অবস্থায় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত হতে রোজার চাঁদ দেখা গেলে এবং সেখানকার মুসলমানদের নিকট থেকে সাক্ষী পাওয়া গেলে এবং তারাবির নামাজের ওয়াক্ত থাকলে তা হলে তারাবির নামাজে না দাঁড়িয়ে পরবর্তী চাঁদের জন্য অপেক্ষা করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

পরিশেষে আলেম-ওলামা ও বুজুর্গণদের নিকট আরজ, তারা যেন এ বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা এবং এই পবিত্র রমজান এবং ঈদ উদযাপনের বিষয়ে সকলকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভ্রান্তির পথ থেকে সঠিক পথের দিকে নির্দেশনা দেন। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সঠিক জ্ঞান ও শান্তি দান করুন। আমিন।

লেখক : সৈয়্যেদ শাহ নূরে পারভেজ, গ্রাম+পোঃ সুরেশ্বর, জেলা : শরীয়তপুর।

মন্তব্য করুন: