শুভ নববর্ষ ১৪২৯
রমনায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু
ছবি: সংগৃহীত
করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর রমনার বটমূলে চিরাচরিত নিয়মে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বংশীবাদন, গান, কবিতায় বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। বরাবরের মতো এবারও বাঁশিতে ভোরের রাগালাপ ‘মন, জাগ' মঙ্গললোকে অমল অমৃতময় নব আলোকে জ্যোতিবিভাসিত চোখে...’ গেয়ে বুধবার ভোর সোয়া ছয়টায় শুরু বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এবারের পরিবেশনে অংশ নেওয়া শিল্পী সংখ্যা ৮৫ জন। শিল্পীদের এ সংখ্যা আগে ছিল প্রায় দেড়শ'।
ছায়ানটের অনুষ্ঠানস্থল তথা পুরো রমনা পার্ক এলাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ছায়ানটের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে জরা, ব্যাধি এবং শঙ্কাগুলো ছিল সে সকল বিষয় কাটিয়ে আজ থেকে নতুন একটি বছর শুরু হলো। নতুন বছরটি স্বপ্নে উচ্ছ্বসিত হবার মতো একটি বছর হবে এমনটিই প্রত্যাশা ছায়ানটের।
বর্ষবরণের পাশাপাশি দেশের মানুষকেও নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানায় ছায়ানট।
ছায়ানটের পাশাপাশি বর্ষবরণে থাকছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলা অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণে রকমারি কারুপণ্যের সম্ভার নিয়ে বৈশাখী মেলা প্রভৃতি। সাধারণত নববর্ষে পান্তা-ইলিশসহ নানা রকম দেশি খাবারের আয়োজন থাকে। তবে এবার পবিত্র রমজানে দিনের বেলায় এসব খাবারের আয়োজন থাকছে না। আর সব কর্মসূচিও রমজানের মর্যাদা রক্ষা করে পালন করা হবে বলে আগেই জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কারণে এবার বেলা দুইটার মধ্যে পয়লা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে। বেলা একটার পর উৎসব এলাকায় কাউকে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। আর সকাল সাড়ে ৯টায় টিএসসি থেকে শোভাযাত্রা শুরুর পর আর কেউ ঢুকতে পারবে না।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের।
রাজধানীতে ১৯৬৭ সালে প্রথম রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের সূর্যোদয়ের সময় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট। সেই অনুষ্ঠানই মূলত নববর্ষ বরণের সাংস্কৃতিক উৎসবকে সারাদেশে বিস্তারিত হতে প্রেরণা সঞ্চার করেছে।
সেই থেকে (১৯৬৭) পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের একটা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গও হয়ে উঠেছে ছায়ানটের বর্ষবরণের রেওয়াজ। এরপর কেবল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈরী পরিবেশের কারণে অনুষ্ঠান হতে পারেনি। ২০০১ সালে এ গানের অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা ভয়াবহ বোমা হামলা করলেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
এপ্রিল ১৪, ২০২২
এসবিডি/এবি/
মন্তব্য করুন: