নোয়াখালীতে মা-মেয়ে খুনের নেপথ্যে পরকীয়ার কথা বললেন খুনী
গৃহবধূ নুরুন্নাহারের সঙ্গে মোবাইলে রং নাম্বারে পরিচয় হয় প্রবাসে থাকা অবস্থায় আলতাফ হোসেনের। কথা বলতে বলতে নোয়াখালীতে থাকা নূর নাহার এবং ওমানে থাকা আলতাফের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেমিকার আশ্বাসে ভিসা বাতিল করে গত ৮ জুন দেশে আসেন।
নূর নাহার দুই সন্তানের মা। দেশে সংসার আছে আলতাফেরও। ১০ বছর ওমানে কর্মরত থাকলেও তার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। নূর নাহার তাকে আর্থিক সহযোগিতা ও আড়াই লাখ টাকা ঋণ পরিশোধের আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে নিজের বাড়ির নিচতলায় ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানান।
সেখানে প্রতিশ্রুতির আড়াই লাখ টাকা দিতে না পারায় আলতাফের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে পকেটে থাকা ছুরি দিয়ে নুরুন্নাহারের গলায় আঘাত করেন আলতাফ। ওই সময় চিৎকার দিয়ে মেয়ের রুমে চলে যান ওই গৃহবধূ। ওই সময় মেয়ে ফাতেহা আজিম প্রিয়ন্তী ঘুম থেকে উঠে মাকে বাঁচানোর জন্য মায়ের পিঠের ওপর পড়লে আসামি তাকেও এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেন। আশ্বাস অনুযায়ী সহযোগিতা না পাওয়ায় ঘটে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা, জানিয়েছে পুলিশ।
বুধবার (১৪ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নোয়াখালীর মাইজদীতে বাড়িতে ঢুকে নূর নাহার বেগম (৩৫) ও তার মেয়ে ফাতেমা আজিম প্রিয়ন্তীকে (১৬) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় স্থানীয়রা ধাওয়া দিয়ে রক্তমাখা অবস্থায় আলতাফ হোসেনকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় সুধারাম মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলন করেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, বুধবার রাত ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নোয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি আলতাফ হোসেন। আলতাফ হোসেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের চর মেহের গ্রামের মৃত আবুল কালামের ছেলে।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার আরও বলেন, নিহত নূর নাহার বেগমের স্বামী ফজলে আজিম কচি জেলা শহরে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করেন। ওই বাড়ির দোতলায় তিনি স্ত্রী নূর নাহার, মেয়ে প্রিয়ন্তী ও ছেলে রবিউল আলম হৃদয়কে নিয়ে থাকেন। নিচতলায় ভাড়াটেরা থাকেন। প্রিয়ন্তী চলতি বছর স্থানীয় হরিনারায়ণপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলে হৃদয় একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র।
তিনি বলেন, আলতাফ দেশে ফিরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নোয়াখালী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড মধুপুর এলাকায় থাকতেন। আলতাফ একাধিকবার নূর নাহারের সঙ্গে দেখা করে ব্যবসার জন্য টাকা চান। কিন্তু নূর নাহার তাকে টাকা দেওয়ার কথা বলে ঘোরাচ্ছিলেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দুপুরে নূর নাহারের স্বামীর অনুপস্থিতিতে আলতাফ বাসায় এসে টাকা চায়। নূর নাহার তাকে বুধবার আসার জন্য বলেন। এক পর্যায়ে আলতাফ বুঝতে পারে, নূর নাহার তাকে টাকা দেবেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বুধবার সকালে আলতাফ ভয়ভীতি দেখানোর জন্য ফুটপাত থেকে একটি ছুরি কিনে নূর নাহারের বাসায় যায়। এ সময় নূর নাহারের মেয়ে প্রিয়ন্তী ঘুমে ও ছেলে হৃদয় স্কুলে ছিল। ফাঁকা বাসায় নূর নাহার ও আলতাফের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে নূর নাহার আলতাফকে পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেন। এ পর্যায়ে আলতাফ ছুরি দিয়ে নূর নাহারকে উপর্যুপরি আঘাত করে। এ সময় মায়ের চিৎকারে প্রিয়ন্তীর ঘুম ভেঙে গেলে সে দৌড়ে আসে। আলতাফ ভয়ে তাকেও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়ে।
তবে আসামির নুরুন্নাহারের মেয়ে প্রিয়ন্তীকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল না উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, নুরুন্নাহার তার মেয়ের রুমে যাওয়ার পর সেখানে গিয়ে তার গলায় ও ঘাড়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন আসামি। ওই সময় মেয়ে ফাতেহা আজিম প্রিয়ন্তী ঘুম থেকে উঠে মাকে বাঁচানোর জন্য মায়ের পিঠের ওপর পড়লে আসামি তাকেও এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেন। মূলত প্রতারণা করায় নুরুন্নাহারকে হত্যা করে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন-অর্থ) বিজয়া সেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোর্তহীন বিল্লাহ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেগমগঞ্জ সার্কেল) নাজমুল হাসান রাজিব, সুধারাম মডেল থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম ও ডিবির ওসি নাজিম উদ্দিন আহমেদ।
এর আগে সকালে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন-অর্থ) বিজয়া সেন জানিয়েছিলেন, পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে, হত্যাকাণ্ডে তিনজন অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে দু’জন পালিয়ে গেছে। আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ সেগুলো নিয়ে কাজ করছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাত ৮টা থেকে ১ নম্বর আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এস.এম মোসলেহ উদ্দিন মিজান আসামি আলতাফ হোসেনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি রেকর্ডের পর আদালতের নির্দেশে তাকে রাত ১১টার দিকে নোয়াখালী জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিকে বুধবার বিকেলে প্রিয়ন্তীর খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে তার সহপাঠী ও বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে।
অন্যদিকে গ্রেপ্তার আলতাফ হোসেন জবানবন্দিতে যেসব কথা বলেছেন, সেটা মানতে নারাজ নিহত নুর নাহার বেগমের স্বামী ফজলে আজিম। তার দাবি, আলতাফের বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
তিনি বলেন, গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় জেলা পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এবং তার ছেলে কথা বলতে চাইলেও পুলিশ তাদের কথা বলতে দেয়নি। আটকের পর আলতাফ হোসেন বাড়িতে আরও দুই ব্যক্তিকে দেখার কথা বলেছেন। ওই দুই ব্যক্তি কারা, সেটি বের করা দরকার। তা ছাড়া ঘটনার আগের দিন এক লোক বাসা ভাড়া নিতে এসেছিলেন। বাড়ির অপর ভাড়াটিয়ার মুঠোফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছেন ফজলে আজিম। তার বিষয়েও খোঁজ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল ইসলাম একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আলতাফ হোসেন আটক হওয়ার পর প্রথমে দীর্ঘ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। তিনি একটা কাহিনি তৈরি করেছেন। এখন আমাদের কাছে ও আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে সেই কাহিনি বলছেন। তার জবানবন্দির কতটুকু সত্য, সেটা আমরা পরবর্তী সময়ে তদন্তে বের করে আনার চেষ্টা করব। নতুন কিছু থাকলে তা-ও বের হয়ে আসবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মামলা হয়েছে অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে। যেহেতু মামলা আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে হয়নি, সে ক্ষেত্রে তদন্তে নতুন কিছু বেরিয়ে আসার সুযোগ তো আছে। তবে তদন্তে কোনো অংশই বাদ যাবে না। সবকিছুই আমলে নেওয়া হবে।
জুন ১৫, ২০২৩
এসবিডি/এবি/
মন্তব্য করুন: