সমস্যা সমাধানের নামে ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেন ‘দরবেশ বাবা’
‘দরবেশ বাবা’ পরিচয়ে পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেওয়ার কথা বলে সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক নারী কর্মকর্তার কাছ থেকে ধাপে ধাপে ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র।
পরে যখন বুঝতে পারেন যে, তিনি প্রতারিত হচ্ছেন তখন রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দরবেশ বাবা পরিচয়দানকারী মো. হাসেম ও তার সহযোগী তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এর মধ্যে হাসেমের গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ফুলকাচিয়া এলাকায় এবং তানজিলের বাড়ি লাললমোহন উপজেলায়।
রবিবার সিআইডির প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সিআইডি জানায়, প্রতারণার শিকার নারীর নাম আনোয়ারা বেগম। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার তিন ছেলে-মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। তার স্বামী দেশের একজন নামকরা চিকিৎসক। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। পারিবারিক সমস্যা থাকায় মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। এ অবস্থায় ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখে তার চোখ আটকে যায়।
বিজ্ঞাপনে একজন সুদর্শন ব্যক্তি দরবেশ বেশধারী নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, সন্তান না হওয়া ও লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দেন তিনি।
বিজ্ঞাপনটি মন কাড়ে আনোয়ারার। পরবর্তীতে বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন তিনি। অপরপ্রান্তে থাকা দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি সুন্দরভাবে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। আনোয়ারা পরিবারের সমস্যার কথা তুলে ধরেন দরবেশ বাবার কাছে।
সমস্যার কথা শুনে আনোয়ারাকে বলেন, ‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার উপর আস্থা রাখো। তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। জানালে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং সমস্যা আরো বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’
আনোয়ারা ভণ্ড দরবেশের কথায় তার ভক্ত হয়ে যান। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দরবেশ বাবার কাছে টাকা পাঠান তিনি।
গ্রেপ্তার হাসেম নিজেকে দরবেশ পরিচয় দিতেন। আর সহযোগী তানজিলকে আনোয়ারার কাছে পাঠাতেন টাকা আনতে। একবারে ৩০-৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিতেন। এভাবে চক্রটি ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই নারীর কাছ থেকে।
একপর্যায়ে আনোয়ারা বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। এরপরই তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন এবং সিআইডিতে অভিযোগ করেন। ওই নারীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম তদন্তে নেমে হাসেম ও তানজিলকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, হাসেম জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন ২০০৫ সাল থেকে তিনি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতেন। ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন। প্রতি মাসে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ হত চার লাখ টাক।
মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্প শিক্ষিত বাংলাদেশি প্রবাসীদের টার্গেট করে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এ ছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন তিনি। মানুষকে ভয়-ভীতি ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত চক্রটি।
দরবেশ বাবা পরিচয় দেওয়া হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানান, এই প্রতারক একাধিক মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স প্রবাসী ইমাম হোসেনের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়াও এক ইতালী প্রবাসীর কাছ থেকে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। মধ্যপ্রাচ্যে এই চক্রের ২০-২৫ জন ও মালয়েশিয়ায় ১০-১২ জন কথিত ভক্ত আছে, যাদের কাছ থেকে তারা টাকা হাতিয়ে আসছে।
প্রতারিত আনোয়ারা বেগম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গত বছরের আগস্টে দরবেশ পরিচয়দানকারী ওই প্রতারকের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল। প্রথমে প্রতারক বিকাশের মাধ্যমে ৯ হাজার টাকা নিয়েছিল। এরপর থেকে মোটা অংকের টাকা নিতে থাকে। সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট তাকে ৩৩ লাখ টাকা দিয়েছি।
এত টাকার উৎস সম্পর্কে তিনি বলেন, চাকরির প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশনের টাকা ও ছেলেমেয়েদের এফডিআর ভেঙেছি। এ ছাড়া স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি ও স্বামীর কাছ থেকেও টাকা নিয়ে প্রতারকের হাতে দিয়েছি। স্বজনদের কাছ থেকে ৭৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তাকে দিয়েছি। পরে বুঝতে পারি, প্রতারণার শিকার হয়েছি।
সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩
এসবিডি/এবি/
মন্তব্য করুন: