শিল্পপতি জসিম হত্যা: বান্ধবীকে নিয়ে খুন করেন প্রেমিকা রুমা
ছবি: সংগৃহীত
চাঁদ ডাইংয়ের মালিক শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুম (৫৯)। সেরা করদাতা হিসেবে ‘করবাহাদুর’ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে তার সাত টুকরাে দেহের পরিচয় নিশ্চিতের পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।এর আগে রবিবার রাত থেকে ‘নিখোঁজ’ ছিলেন তিনি।
এই ঘটনায় পরদিন তার বড় ছেলে গুলশান থানায় জিডি করেন। শেষ পর্যন্ত শিল্পপতি মাসুমের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। রুমা আক্তার নামে এক নারীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এরই মধ্যে কাফরুল থেকে রুমা, রুকুসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। হত্যা ও লাশ সরাতে রুমাকে সহায়তা করে তার বান্ধবী রুকু।
জিজ্ঞাসাবাদের পর রূপগঞ্জ থানায় হওয়া হত্যা মামলায় দুই নারীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকি দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
নিহত মাসুম পরিবার নিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর কাফরুলের বাসায় ছিলেন রুমা আক্তার (২৮)। নিরুদ্বেগ চলাফেরা ও ঘুমাতে থাকেন তিনি। বুধবার রাতে পুলিশ যখন ওই বাসায় যায়, তখনও তাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে এলোমেলো তথ্য দিলেও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সবকিছু স্বীকার করেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার জানান, ‘অবৈধ সম্পর্কের জেরে শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে জবাই করে হত্যা করেন পরকীয়া প্রেমিকা রুমা। এরপর তিনি গুম করার উদ্দেশে লাশ টুকরা টুকরা করে ব্যাগে ভরে সিএনজিতে করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেন’- পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন রুমা।
নিহতের পরিবারের সদস্য ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রবিবার বিকেলে মাসুম তার বাসা থেকে বের হয়ে গুলশান যান। এর পর ব্যক্তিগত চালককে বাসায় ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। মালেক নামে আরেক গাড়ির চালককে নিয়ে নারায়ণঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু রবিবার রাত ১১টা পর্যন্ত মাসুমের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। কোনো খোঁজ না পেয়ে পরদিন সোমবার গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বড় ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু। এর পর তদন্তে নামে পুলিশের একাধিক সংস্থা।
পরে বুধবার সকালে রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড সড়কের উত্তর পাশে ৫ নম্বর সেক্টরের ব্রাহ্মণখালী এলাকায় লেকের পাড় থেকে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশের সাত টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। তিনটি কালো পলিথিনের ব্যাগে করে অজ্ঞাত যুবকের মাথা, দুই হাত, শরীরের পেছনের অংশ, নাড়িভুঁড়ি, বাঁ পা ও বাঁ ঊরুর কাটা অংশ উদ্ধার করা হয়। এর পর নিশ্চিত হওয়া যায় ওই লাশের টুকরা মাসুমের।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ওই শিল্পপতির গাড়িচালক আবদুল মালেক জানান, ‘নদী জলে শাপলা ভাসে’সহ দুটি সিনেমার প্রযোজক মাসুম। সিনেমা জগতে মিশতে গিয়ে অনেক নায়ক-নায়িকার সঙ্গে তার পরিচয়। এর সূত্র ধরে রুমা আক্তার নামে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তার বাসা কাফরুল। এর আগেও কয়েকবার ওই বাসায় গেছেন শিল্পপতি। তার সন্ধান পেতে ঘটনার পর রুমার বাসায় গেলে তিনি জানান, রোববার বিকেলে সেখানে যান মাসুম। আধা ঘণ্টা পর বাসা থেকে চলে যান।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা দেখেছেন, রোববার বিকেলে রুমার কাফরুলের ফ্ল্যাটে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে একাকী ঢুকেছেন মাসুম। এর পর তাকে আর বের হতে দেখা যায়নি। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রুমা ও আরেক তরুণ দুটি ভারী ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। এর আগে তরুণকে ওই বাসায় ঢুকতে দেখা গেছে।পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রুমা প্রথমে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরে ধীরে ধীরে ঠান্ডা মাথায় খুনের পর লাশ গুমের বর্ণনা দেন।
তিনি দাবি করেন, কাফরুলের তিন কক্ষের ওই ফ্ল্যাটে তার ছোট বোন, বান্ধবী, ভাবী ও তার বাচ্চা থাকে। দুধের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে অজ্ঞান করা হয় মাসুমকে। দুদিন এভাবে থাকার পর মঙ্গলবার একটি কক্ষের বাথরুমে হত্যার পর লাশ ১১ টুকরা করা হয়। এর পর তার এক বন্ধুকে দুটি ব্যাগ নিয়ে আসার কথা বলেন। দুটি ব্যাগে ভরে সাত টুকরা রূপগঞ্জের একটি লেকের পাড়ে এবং অন্য চারটি অংশ ৩০০ ফিট এলাকায় একটি কাশবনে ফেলে আসেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার রুমার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাশবন থেকে চারটি টুকরাে উদ্ধার করে পুলিশ। সেখানে হাত, পা ও কোমর থেকে বুকের খণ্ডিত অংশ ছিল।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক কথা বলছেন রুমা। কখনও বলছেন, ‘সম্পর্কের’ জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। রুমার সঙ্গে শিল্পপতি মাসুমের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এর পাশাপাশি মাসুম অন্য আরেক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিষয়টি জানতে পেরে রাগ-ক্ষোভ ও আবেগের বশে তাকে খুন করে।
ঘটনার দিন এক তরুণীকে নিয়ে মাসুম কাফরুলের বাসায় গিয়েছিলেন বলে দাবি করেন রুমা। তবে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে কোনো তরুণীকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে দেখা যায়নি।
রুমার ভাষ্য, মাসুমের হাতে যে ব্যাগ ছিল, সেটিতে ৫ কেজি গরুর মাংস ছিল।
স্বজনসহ অনেকের প্রশ্ন, ফ্ল্যাটে আরও অনেক বাসিন্দা থাকলেও কীভাবে একাকী একজনকে হত্যার পর লাশ এত টুকরা করা হলো। রুমার দাবি, ফ্ল্যাটের অন্যরা খুনের বিষয়টি জানতেন না। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি, ব্লেড বনানীর ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসায় রেখে আসেন রুমা। ওই বাসাটি মিউজিকের কাজে ব্যবহার করতেন তিনি। ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে চাপাতি, ব্লেড ও মাসুমের কিছু কাপড়চোপড় জব্দ করা হয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রযুক্তিগত তদন্তে মঙ্গলবার রাতে রূপগঞ্জে রুমার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার পাশাপাশি লাশ গুমে সরাসরি জড়িত তিনি।
গ্রেপ্তার রুমা আক্তারের বাড়ি ময়মনসিংহের তারকান্দা থাকা এলাকায়। তার বাবার নাম নজর আলী।
রুমার জবানবন্দির বরাতে পুলিশ সুপার জানান, গত ১০ নভেম্বর রাতে রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মূলত সেখানে একটি ভাড়া বাড়িতে তারা একত্রিত হতেন। প্রথমে ব্যবসায়ী মাসুমকে দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করা হয়। এরপর চাপাতি দিয়ে তাকে জবাই করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়।
এ ব্যাপারে নিহতের বড় ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু তার বাবার হত্যাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, আমার বাবাকে হত্যার পর শরীর যেভাবে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
এর আগে বুধবার দুপুরে কুড়িল-কাঞ্চন সড়কের উত্তর পাশে পূর্বাচলের ৫ নম্বর সেক্টর থেকে তিনটি পলিথিন ব্যাগে মোড়ানো লাশের খন্ডাংশগুলো উদ্ধার করা হয় বলে জানান রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বুধবার সকালে কাঞ্চন-কুড়িল সড়কের পাশে লেকের পানিতে হাত ধোয়ার সময় দুর্গন্ধ পান স্থানীয় এক রিকশাচালক। পরে তিনি আরও কয়েকজনকে ডাক দেন। তারা পলিথিনে মোড়ানো ব্যাগগুলো দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ এসে কালো রঙের তিনটি পৃথক পলিথিন ব্যাগে মরদেহের খন্ডাংশগুলো উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পরে নিহতের ছেলে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে বাবার লাশ শনাক্ত করেন। সূত্র: সমকাল
এসবিডি/এবি
মন্তব্য করুন: