সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অবঃ) ড. মোঃ ফসিউর রহমান
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ি
ছবি: সময়বিডি.কম
বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজিএমএস) পদ থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ড. মোঃ ফসিউর রহমান। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। এ আওয়ামী লীগ নেতা পাবনার চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের মৃত দেলমাহমুদ ও জসিমন নেসার দ্বিতীয় সন্তান। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে বেড়িয়ে এসেছে তার জীবনের নানাদিক। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক ইকবাল কবীর রনজু।
ইকবাল কবীর রনজু: আপনার জন্ম কত সালে?
মে.জে. ফসিউর: ৩১ জুলাই ১৯৫৯ সালে।
ইকবাল কবীর রনজু: পড়াশুনা কোথায় করেছেন?
মে.জে. ফসিউর: অষ্টমনিষা প্রাইমারি স্কুলে শিশু শ্রেণির পড়া শুরু। তখন বটতলায় ক্লাস হতো। এরপর সম্ভবতঃ ১৯৬৪ সালে পাবনার পৈলানপুর সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পড়ি। বাবার বদলীর কারণে ১৯৬৮ সালের পুনরায় অষ্টমনিষা প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করি। পরবর্তীতে বগুড়া মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করি। বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ১৯৭৭ সালে শেষের দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই।
ইকবাল কবীর রনজু: বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হলেন কিভাবে?
মে.জে. ফসিউর: শেখ মুজিবুর রহমানের পাবনার ঈশ্বরদীতে বক্তৃতা শুনতে যাওয়া, পাবনা টাউনহল ময়দানে বক্তৃতা শোনা এবং বাসায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা শোনা থেকে শুরু বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হওয়া। সেই থেকে তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হই।
ইকবাল কবীর রনজু: ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন?
মে.জে. ফসিউর: আমার বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুথানের সময় গোটা দেশেই মিছিলের জোয়ার। ক্লাস সিক্সে পড়ি। তখন প্রায় প্রতিদিনই মিছিল করতাম - জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। সোনার বাংলা শ্মশান কেন, আইউব শাহী জবাব চাই। পাকিস্তান দেশ কৃষ্টি পুস্তিকা, বাতিল করো, বাতিল করো ইত্যাদি স্লোগান দিতাম। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেন। উনি বঙ্গবন্ধু হলেন। সে কি আনন্দ! সরকারি আজিজুল হক কলেজে লেখাপড়া করার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় (১৯৭৮-১৯৮৪) ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম।
ইকবাল কবীর রনজু: মুুক্তিযুদ্ধে আপনার ভূমিকা ছিল?
মে.জে.ফসিউর: আমি তখন ছোট, বয়স তখন তেরো-চৌদ্দ হবে। পাবনার ভাঙ্গুড়ার শাহানগরে আমার নানার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতেন। একেক সময় বিশ-পঁচিশ জন করে আসতেন। আমরা সে সময় নানা বাড়িতে ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিশ্রাম নিত সে সময় আমি ও আমার বড়ভাই আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ধানের খড়, কাপড় দিয়ে কোনো ঘরের চাতালে বা ঘসির (ঘুটে) ঘরে লুকিয়ে রাখতাম। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারে কাছ থেকে স্টেনগান ফায়ার করা শিখি।
ইকবাল কবীর রনজু: কর্মজীবনের শুরু কোথায়?
মে.জে.ফসিউর: এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগদান করি। বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল সার্ভিসেস এর ডিরেক্টর জেনারেল, আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের কমান্ড্যান্ট (অধ্যক্ষ), ঢাকা সিএমএইচ এর কমান্ড্যান্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্বসহ আরো অনেক দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। এছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য।
ইকবাল কবীর রনজু: আপনার অন্যান্য ডিগ্রি?
মে.জে.ফসিউর: মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি, মাস্টার অব পাবলিক হেলথ (এমপিএইচ), ফেলো অব দি কলেজ অব জেনারেল প্র্যাকটিশনার (এফসিজিপি), মাস্টার অব সিকিউরিটি স্টাডিজ (এমএসএস), মাস্টার অব বিজিনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ), ব্যাচেলর অব ল' (এলএলবি) ডিগ্রি অর্জন ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি) সম্পন্ন করেছি। ফ্রান্সের মার্সাই এ শান্তি সহায়ক কার্যক্রমের প্রস্তুতিমূলক কোর্স সম্পন্ন করেছি।
ইকবাল কবীর রনজু: অন্যান্য কি দায়িত্ব পালন করেছেন?
মে.জে.ফসিউর: নবম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস (বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন) এর সহ-সভাপতি, নবম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস (বিওজি) এর মেডিকেল কমিটির সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য’র দয়িত্ব পালন করেছি। আমি মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল থাকাকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চাটমোহরের আলোচিত জোড়া মাথার জমজ সন্তান রোকেয়া-রাবেয়ার সেপারেশন অপারেশনের দায়িত্বও পালন করি।
ইকবাল কবীর রনজু: আপনার প্রকাশনা?
মে.জে.ফসিউর: “স্বাধীনতা যুদ্ধে আর্মি মেডিকেল কোর” নামক একটি পুস্তক সম্পাদনা করেছি। এ ছাড়া আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ, চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, সিএমএচ ঢাকা ও আর্মি ডেন্টাল কোরের প্রকাশিত জার্নালসহ দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা প্রায় ৫০টিরও অধিক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
ইকবাল কবীর রনজু: অন্যান্য ক্ষেত্রে আপনার সম্পৃক্ততা?
মে.জে.ফসিউর: আমি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর আজীবন সদস্য। এছাড়া আইসিএমএম, এসসিসিএম, আইসিএমএমএস এর সদস্য। বিইউপি’র সিনেট সদস্যের দায়িত্বও পালন করেছি।
ইকবাল কবীর রনজু: সম্মেলনে অংশগ্রহন?
মে.জে.ফসিউর: ২০১২ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত “ডব্লিউএইচও” এর হেলথ প্রোগ্রাম, ২০১৭ সালে ব্যাংককে আইসিএমএমএস-এর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহন করি। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সেমিনারে অংশগ্রহণ করি এবং ব্রেইন ইনজুরির উপর একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করি।
ইকবাল কবীর রনজু: কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন?
মে.জে.ফসিউর: কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরষ্কার, একইবছরে সেনা গৌরব পদক পাই। ২০১৯ সালে সেনা পারদর্শিতা পদক পাই। এছাড়া জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহন করে সফলতার স্বাক্ষর রাখায় লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন ও মোজাম্বিকে শান্তিরক্ষা পদক পেয়েছি। এছাড়া আরো বেশ কিছু পদক পেয়েছি।
ইকবাল কবীর রনজু: তিক্ত অভিজ্ঞতা?
মে.জে.ফসিউর: তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার জীবনে নেই। আমি সব কিছুকে পজিটিভলি নেই। এমনকি নেগেটিভ বিষয়গুলোকেও।
ইকবাল কবীর রনজু: বিএনপি জোট সরকারের আমলে চাকুরিতে কি অবস্থায় ছিলেন?
মে.জে.ফসিউর: আমরা তিন ভাই চিকিৎসক। এই তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই সেনাবাহিনীতে ছিলাম। আমার ছোটভাই পুলিশ কর্মকর্তা। বিএনপি জোট সরকারের সময় আমাদের তিন ভাইকে প্রায় একই সময়ে পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়িতে পোস্টিং দেয়। চাকুরিতো করতেই হবে। কখনো সমতলে কখনো পাহাড়ে। তাই বলে তিন ভাইকে এক সাথে খাগড়াছড়ি! “তিন সহোদর খাগড়াছড়িতে” এ শিরোনামে ওখানকার স্থানীয় সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ করে। ওই দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে।
ইকবাল কবীর রনজু: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলবেন?
মে.জে.ফসিউর: ব্যাক্তি জীবনে আমি বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক। আমার স্ত্রী সেলিনা বানু এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড এর ডিজিএম কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স (ঢাকা) এবং টাঙ্গাইলের মধুপুরের এসেনসিয়াল ল্যাটেক্স প্রসেসিং এর প্লান্ট ম্যানেজার ছিলেন। সেও এখন অবসরে আছে। আমাদের একমাত্র সন্তান জাওয়াদ মাহমুদ ওয়াফি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র।
ইকবাল কবীর রনজু: আপনার সামাজিক কর্মকাণ্ড?
মে.জে.ফসিউর: আমি অনেক রোগির চিকিৎসা ও হাসপাতালে ভর্তির কাজে সহায়তা করেছি। অনেক মানুষের ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করেছি। বিবাহ, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ও অনেককে সহায়তা করতে পেরেছি। চাটমোহরের মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজ ও এম এ আউয়াল টেকনিক্যাল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠায় আমার ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মসজিদ, এতিমখানাসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সহায়তা করেছি, রিলিফ কার্যক্রম ও মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করে অনেক দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করেছি। বিভিন্ন সময়ে শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছি, ঈদের সময় সাধ্যানুযায়ী গরীব দুস্থ্যদের সহায়তা করেছি।
ইকবাল কবীর রনজু: আপনি কি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী?
মে.জে.ফসিউর: আমি চাকরিজীবনে আল্লাহর সহায়তায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করেছি। আরো বেশি কাজ করতে চাই। এখন অবসরে আছি। পাবনা-৩ এলাকার জনগন চাইলে এ এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে চাই। এজন্য এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন চাইবো। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুগত ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আশাকরি জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিবেন। আমি মনোনয়ন পেলে এবং পাবনা-৩ এলাকার (চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর) মানুষ সহযোগিতা করে আমাকে নির্বাচিত করলে এ এলাকার উন্নয়ন করার সুযোগ পাবো। মানুষের পাশে থাকতে পারবো।
ইকবাল কবীর রনজু: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মে.জে.ফসিউর: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
মে ২২, ২০২৩
ইকবাল কবীর রনজু/এবি/
মন্তব্য করুন: