ঈশ্বরগঞ্জের ইতিবৃত্ত ও অজানা কিছু ইতিহাস
ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণের বয়স প্রায় পৌনে দুই শ বছর। এই নামের উত্পত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কবে, কখন, কিভাবে ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণ হয়েছিল তা বলা দুরূহ ব্যাপার। এ নামকরণ সম্পর্কে তেমন কোন দালিলিক প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। তবে ‘ঈশ্বরগঞ্জ’ নামটি কীভাবে এলো, তা নিয়ে এবং পর্যাক্রমে ইতিহাসের কিছু তথা উপাদান সংগ্রহ করেছে এসিক এসোসিয়েশন (ACECC Association), ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি অ্যান্ড লাইব্রেরি এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে।
সরেজমিন ও গবেষণার মাধ্যমে ঈশ্বরগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের গোড়াপত্তন
ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ নিয়ে দুএকটি কাহিনী পাওয়া যায়। ঈশ্বরগঞ্জ রাখার পেছনে রয়েছে গৌরীপুরের বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদারদের ইতিহাস। কীভাবে একটি নৌবন্দর বা নতুন গঞ্জের নাম ঈশ্বরগঞ্জ রাখা হলো- এ বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেন বিভিন্ন ইতিহাসবিদরা। অনেকে মনে করেন ঈশ্বরগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল পিতলগঞ্জ। সরেজমিনে দেখা যায়, কাঁচামাটিয়া নদীর ধারে পুম্বাইল এফ ইউ ফাজিল মাদ্রাসাসহ কিছু এলাকা নিয়ে পিতলগঞ্জ।
এই মাদ্রাসার অর্থনীতি বিষয়ের প্রভাষক মো. মাহমুদুল হাসান শামীম বলেন, পিতলগঞ্জ তামা, কাঁসা ও পিতলের জিনিসের জন্য একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক এলাকা ও নদীবন্দর ছিল। পুম্বাইল (পিতলগঞ্জ) হতে এক কিলোমিটার পূর্বে দত্তপাড়া চরনিখলা মৌজায় ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের গোড়াপত্তন হয়। তাছাড়া বর্তমানে এই নামে দক্ষিণে অর্থাৎ হোসেনপুর উপজেলার ২নং সিদলা ইউনিয়নে পিতলগঞ্জ বাজার রয়েছে। কথিত আছে যে, নদীবিধৌত এ অঞ্চলে মাঝি ও জেলে সম্প্রদায়ের কিছু বিচ্ছিন্ন উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। তখন থেকেই ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণের কিংবদন্তি শুনে আসছে সাধারণ মানুষ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের শাসন-শোষণে একজন ইংরেজ হত্যাকারী ও খেয়াঘাটের মাঝির নামে ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল এই নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকদের মতবিরোধ রয়েছে। মাঝির নাম ছিল ঈশ্বরপাটনী। তখনকার সময়ে ইংরেজ ও জমিদারদের অনুমতি ও সাহায্য ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান করা অসম্ভব ছিল। কিংবদন্তির উপর নির্ভর করে বর্তমানে ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ হয়েেছ।
ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণ নিয়ে স্থানীয় লোকদের মধ্যে অনেকের যুক্তি খণ্ডন করা করা হয়েছে যে, তারা সঠিক ইতিহাস জানে না। কিন্তু প্রকৃকপক্ষে এক জমিদারের ছেলের নামে ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল।
ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণের অজানা কিছু ইতিহাস
মোমেনসিং পরগণার মধ্যে ঈশ্বরগঞ্জের গোড়াপত্তন ও নামকরণ করা হয়। মোমেনসিং পরগণার জায়গিরদার ছিলেন বোকাইনগরের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। বীরযোদ্ধা খাজা উসমান খাঁর আমলে মোমেনসিং পরগণাসহ বেশ কয়েকটি পরগণার রাজধানী ছিল কেল্লা বোকাইনগরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বোকাইনগরের প্রাচীন শহরটি কালেক্টরেটের (সরকারি রাজস্বের) অধীনে চলে আসে। তৎকালীন সময়ে ময়মনসিংহ জেলার প্রধান ও প্রতিষ্ঠাকালীন কালেক্টর ছিলেন ডব্লিউ রটন ( W Wroughton, Collector of Momensing) সাহেব।
গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুরের তৎকালীন জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর লেখা ‘কেল্লা বোকাইনগর (সচিত্র)’ ফিচার বাংলা ১৩২০ সালে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ নামে মাসিক পত্রিকায় বোকাইনগরের শহর ও কেল্লার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ফিচারটি থেকে প্রাচীন নগর বা শহর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো - ‘এখনও খলিফাপটি বেনেপটি, তামাকপটি, প্রভৃতি নাম পূর্ব্বগৌরবের পরিচয় দিতেছে। কয়েকঘর তন্তুবায় অদ্যাপি এখানে বস্ত্রবয়ন দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছে! বর্তমানে পূর্ব শিল্পগৌরব ও নগরবৈভব পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে। কোন সময় হইতে বোকাইনগরের অবনতি আরম্ভ হয় তাহা জানা যায় না। বোকাইনগর জমিদারের অধীন নহে, ইহা কালেক্টরীর খাস্ মহালভুক্ত। কিছু দিন পূর্ব্বে যে স্থান ভীষণ হিংস্র জন্তুর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল।’
এই উদ্ধৃতি প্রমাণ করে বোকাইনগরকে বলা হয় ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুর উপজেলার প্রাচীন শহর। উল্লেখ্য, বোকাইনগর দুই উপজেলার মাঝে অবস্থান। ঈশ্বরগঞ্জ শহর হতে মাত্র ৫ কিলো দূরে কেল্লা বোকাইনগর অবস্থান। মোমেনসিং পরগণার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষ্মীনারায়ণ এই চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। গৌরীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন কৃষ্ণগোপালের দত্তকপুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী, রামগোপালপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন প্রয়াত কৃষ্ণকিশোর রায় চৌধুরীর দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নী দেবী, কালীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী এবং বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী।
১৭৭০ সালে যুগলকিশোর রায় চৌধুরী (হিন্দু জমিদার পরিবারের পরিচয়ে বেড়ে ওঠা নবাব সিরাজের অপর স্ত্রী আলেয়ার গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান) গৌরীপুর শহর প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায়, পরবর্তীতে বোকাইনগর বাসাবাড়ি হতে আরো তিনটি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া লক্ষ্মীগঞ্জ, ভবানীপুর, গোলকপুর, গোবিন্দপুর, গোবিন্দগঞ্জ (মালঞ্চ), শ্যামগঞ্জ, শ্যামপুর (মেলান্দহ), শম্ভুগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জ ইত্যাদি স্থানের নামকরণ লক্ষ্মীনারায়ণের বংশ তালিকা হতে সৃষ্টি। যেমন- লক্ষ্মীনারায়ণের স্ত্রী ভবানী দেবীর নামে ভবানীপুর এবং নাতনী গোলকমণির নামে গোলকপুরের নামকরণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীনারায়ণের নামে লক্ষ্মীগঞ্জ নামকরণ করা হয়েছে। ঈশ্বরগঞ্জের দক্ষিণে লক্ষ্মীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড অবস্থিত।
ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের প্রতিষ্ঠাতা বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার শম্ভুচন্দ্ৰ চৌধুরী
লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র তিন ছেলে পিতার সম্পত্তির অধিকারী হয়ে কিছুদিন একত্রে ছিলেন। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। শ্যামচন্দ্র চৌধুরী পৃথকভাবে বাসাবাড়ির কাছেই বাসস্থান তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। শ্যামচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার একমাত্র উপযুক্ত বংশধর শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তিনি অতি ধৈর্যশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তার অমায়িক ব্যবহারে, ন্যায় বিচারে, সুশাসনে প্রজাদের সুখশান্তির সহিত জমিদারিরও বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। তিনি ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে তার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারের নাম শম্ভুগঞ্জ। বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত একটি শহরাঞ্চল।
জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজারের সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শম্ভুগঞ্জ বাজার সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘তিনি নিজ নামে একটি বৃহৎ বাজার স্থাপনা করিয়া সাধারণের প্রভূত উপকার সাধন করিয়াছেন। অদ্যাপি শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজার তাহার কীর্তির পরিচয় দিতেছে।’
শম্ভুচন্দ্র প্রথমতঃ অলকমণি দেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে অমরনাথ রায়ের কন্যা মঙ্গলা গৌরীদেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে ঈশানচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র ও হরিশ্চন্দ্র নামে তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশানচন্দ্র অবিবাহিত অবস্থায় পিতা মাতার হৃদয় শূন্য করে পরলোক গমন করেন। মধ্যম পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর নামে বোকাইনগর হতে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে তিনি একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারের নাম ঈশ্বরগঞ্জ।
তখনকার সময়ে ঈশ্বরগঞ্জ ও লক্ষ্মীগঞ্জ শম্ভুগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর শিশুকালে গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রয়াত হরকিশোর রায় চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী ভাগীরথী দেবী দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন এবং তার নতুন নাম রাখেন গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার হিসেবে আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী। কনিষ্ঠ পুত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী পিতামাতার স্নেহ যত্নে লালিত হয়ে ও পিতৃগুণে ভূষিত হয়ে জমিদারির বংশোজ্জ্বল করেন।
শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী বাংলা ১২৬০ (১৮৫৪ খ্রিষ্ট্রাব্দ) সালে বৃন্দাবন ধামে পরলোক গমন করেন। গৌরীপুর রাজবাড়ির জমিদার আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী হরফে ঈশ্বর চন্দ্র চৌধুরীর জীবন অকালে শেষ হওয়ায় তার শিশুপুত্র রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীই সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। রাজেন্দ্র কিশোর বাংলা ১২৫৬ সনের ৫ ভাদ্র (২০ আগস্ট, ১৮৪৯) জন্মগ্রহণ করেন।
নারী জমিদার বিশ্বেশ্বরী দেবীর আমলে ঈশ্বরগঞ্জের উন্নয়ন
মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ও গৌরীপুর রাজবাড়ির চতুর্থ জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১৮৭৩ খ্রিঃ (বাংলা ১২৮০ সালে) ২৪ বছর বয়সে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। রাজেন্দ্র কিশোরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবী সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হলেন। পরবর্তীতে বিশ্বেশ্বরী দেবীর পতির জলপিন্ড সংস্থানের জন্য অর্থাৎ উত্তরাধিকার হিসেবে পুরুষ দ্বারা জমিদারি পরিচালনার জন্য ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১২৮৪ সালে) রাজশাহীর বালিহার গ্রাম নিবাসী হরিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের পুত্র ব্রজেন্দ্র কিশোরকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ব্রজেন্দ্র কিশোরের পূর্ব নাম ছিল রজনী প্রাসাদ ভট্টাচার্য। তিনি অতি অল্প বয়সে দত্তক গৃহীত হয়েছিল।
১২৮১ বঙ্গাব্দের ২৯ বৈশাখে (ইংরেজি ১২ মে, ১৮৭৪ সালে) রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বালিহার গ্রামে ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর জন্ম। বিশ্বেশ্বরী দেবী দত্তক পুত্র নেওয়ার জন্য অনেক জমিদার বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করেন। তার স্বামী রাজেন্দ্র কিশোরের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে রজনী প্রাসাদ ভট্টাচার্যের নামে দত্তক পুত্রের জন্ম হয়। উল্লেখ, বিশ্বেশ্বরী দেবীর শশুর আনন্দ কিশোরের আগের নামেই ঈশ্বরগঞ্জ নামক বাজারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। গৌরীপুরের নারী জমিদার বিশ্বেশ্বরী দেবীর সহযোগিতায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ঈশ্বরগঞ্জ থানার কাছে একটি চৌকি (মুনসেফি) আদালত স্থাপন করে। তখন ব্রজেন্দ্র কিশোরের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় স্থাপিত হয় তার আমলে। বিশ্বেশ্বরী দেবী এমন একজন ত্যাগী ও ধৈর্যশীল নারী ছিলেন তার নাম কালীপুরের ছোটতরফের জমিদার ধরনীকান্ত লাহিড়ীর ‘ভারত ভ্রমণ’ বইয়ের ভূমিকার পাতার উল্লেখ রয়েছে।
প্রাচীন মানচিত্রে ঈশ্বরগঞ্জের তথ্য:
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ঈশ্বরগঞ্জ নামের কোনো বাণিজ্যিক শহর বা বন্দরের অস্তিত্ব প্রাচীন বাংলার মানচিত্রে পাওয়া যায় না। রেনেলের অংকিত মানচিত্রে ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণের পূর্বে বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগণার রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। তাছাড়া বর্তমান ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে মধুপুর ও মাদারগঞ্জ ছিল নদীবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। এই মাদারগঞ্জে সদর জেলার একটি থানা গোড়াপত্তন হয়। পরবর্তী সময়ে মাদারগঞ্জের থানাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
রেনেলের অংকিত মানচিত্রের সূত্রে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় দুটি পরগনার নাম পাওয়া যায়- মোমেনসিং পরগণা ও হোসেনশাহী পরগণা। প্রাচীনকালে বহু নদ-নদী দ্বারা পরগণাগুলো বিভক্ত ছিল। ২৮৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা গঠিত। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ স্থান অর্থাৎ ঈশ্বরগঞ্জের মধ্যে অবস্থিত মোমেনসিং পরগণার সমস্ত ভূমির মালিক গৌরীপুর উপজেলার জমিদারদের মধ্যে ছিল এবং হোসেনশাহী পরগণার ভূমি আঠারবাড়ি ও রাজীবপুরের জমিদারদের অধীনে ছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের প্রকাশিত লেট অ্যান্ড সন মানচিত্রে দেখা যায় ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সদরদপ্তরের এক কিলো পূর্বে অবস্থিত মাইজহাটি গ্রামটির নাম উল্লেখ রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, মাইজহাটি ছিল একসময়ে নদীবন্দর। তাছাড়া ১৮৯৪ সালের প্রকাশিত জনস্টন মানচিত্রে দেখা যায় থানা হিসেবে ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলার কাছে মাদারগঞ্জ, গফরগাঁও, নাসিরাবাদ, ফুলপুর ইত্যাদি স্থানের নাম পাওয়া যায়।
ঈশ্বরগঞ্জে থানার উৎপত্তি ও ইতিহাস
এক সময়ে রাজস্ব ইউনিট ‘পরগণাকে’ ভিত্তি করেই সমস্ত রাজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। পরবর্তীতে দুটো রাজস্ব ইউনিট ‘পরগণা’ ও ‘থানা’ ব্যবহৃত হয়। নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও পরগণা বড় থাকার কারণে বিভিন্ন জরিপ পরগনা ইউনিট ব্যবস্থার অসুবিধা অনুভূত হয়। ফলে ধীরে ধীরে থানা ইউনিট প্রাধান্য পেতে থাকে এবং পরগনা ইউনিট ব্যবস্থার গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। ১৮২৫খ্রিষ্টাব্দের আগে বৃহত্তর ময়মনসিংহে প্রথম যে ১২টি থানা স্থাপিত হয়েছিলো তন্মধ্যে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত মাদারগঞ্জ থানা অন্যতম।
শ্রীকেদারনাথ মজুমদার প্রণীত ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী ১৮২৩ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ১২টি থানা ও ২৫টি কাননগোর কার্যালয় ছিল। ১৮৪৫ সালে জামালপুর মহকুমার সৃষ্টি হলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শাসনকার্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়। শেরপুর, হাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও পিংনা থানা নিয়ে জামালপুর বিভাগ; নসিরাবাদ, গাবতলী; মধুপুর, নেত্রকোণা, ঘোষগাঁও (ফুলপুর), ফতেপুর, গফরগাঁও, মাদারগঞ্জ (ঈশ্বরগঞ্জ), নিকলি ও বাজিতপুর থানা নিয়ে সদর বিভাগ স্থাপিত হয়। ১৮৭১ সাল পর্যন্ত, এ জেলায় ৪টি বিভাগ, ১৬টি থানা ও ১০টি ফাঁড়ি থানা, ১০টি ফৌজদারী ও ১৪টি দেওয়ানী বিচারালয় স্থাপিত হয়েছিল। অতঃপর ১৮৮২ সালে নেত্রকোণা মহকুমা স্থাপিত হয়।
এ জেলায় ৫টি মহকুমা (বিভাগ), ৯টি চৌকী (মুনসেফী), ৩০টি পুলিশ ষ্টেশন (থানা), ও ২১টি সব-রেজেষ্টরী কার্যালয় স্থাপিত হয় । থানা—সদর মহকুমায়—(১) সদর, (২) ফুলবাড়ীয়া, (৩) গফরগাঁও, (৪) নান্দাইল, (৫) ঈশ্বরগঞ্জ ও (৬) ফুলপুর । মোট ৬টি থানা। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত MYMENSINGH DISTRICT GAZETTEER. STATISTICS, 1901-02. তথ্য অনুযায়ী Sadar Subdivision ... 1) Nasirabad, 2) Phulbaria, 3) Ghafargaon, 4) Nandail, 5) Iswarganj, 6) Phulpur, এখানে সদর থানা মানে নাসিরাবাদ থানা। তখন সদর মহকুমায় দুইটি শহর ছিল- নাসিরাবাদ ও মুক্তাগাছা।
ধারণা করা হয় ১৮৮০ সালে অথবা ১৯০০ সালের এর আগে বিশ্বেশ্বরী দেবীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং গৌরীপুরের জমিদারদের সহযোগিতায় মাদারগঞ্জ থানা বিলুপ্ত করে ঈশ্বরগঞ্জ বাজারে স্থানান্তর করা হয় এবং একই সময়ে আঠারবাড়ি জমিদারদের প্রচেষ্টায় নান্দাইলে একটি নতুন থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ মাদারগঞ্জ থানা বিলুপ্ত হয়ে দুটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্রীকেদারনাথ মজুমদারের তথ্য অনুযায়ী ১৯০৫ সালে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় দায়িত্বে ছিলেন ১ জন ইন্সপেক্টর, ২জন সাব-ইন্সপেক্টর, ১ জন হেড কনস্টেবল ২ জন রাইটার কনস্টেবল, ৯ জন কনস্টেবল, ২৯৩ জন চৌকিদার, টাউন চৌকিদার ছিল না এবং ৩০ জন দফাদার। নান্দাইল থানায় দায়িত্বে ছিলেন ১ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ১ জন হেড কনস্টেবল ১জন রাইটার কনস্টেবল, ৮জন কনস্টেবল, ২৩৪জন চৌকিদার, টাউন চৌকিদার ছিল না এবং ২২জন দফাদার।
মাদারগঞ্জ (Moddergunge):
মাদারগঞ্জ ছিল বিখ্যাত নদীবন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বাংলার প্রধান অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর মধ্যে এই বন্দরটি প্রাচীন ও মধ্যযুগেই বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত ছিল। জেমস রেনেলের মানচিত্রে মূল ব্রহ্মপুত্র ও সোহাই নদীর সংযোগ স্থুলে মুদ্দেরগঞ্জ অবস্থিত। ১৭৮৭ সালের আগে ব্রহ্মপুত্র নদটি ২০-২২ কিলোমিটার প্রশস্ত ও খরস্রোতা ছিল। তাছাড়া মোমেনসিং ও হোসেনশাহী এই দুই পরগনার সীমানায় অবস্থিত ছিল নদীবন্দরটি।
জেমস রেনেলের মানচিত্রের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে, কলকাতা থেকে মাদারগঞ্জ পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৭৮ মাইল। তবে ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, কলকাতা ও আসাম থেকে যাত্রী এবং মালামাল নিয়ে মাদারগঞ্জ নৌবন্দরে স্টিমার ভিড়তো। জল পথের সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মাদারগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। তখন মাদারগঞ্জ থানায় ১৩ জন চৌকিদার ছিল। পরবর্তীতে ৫টি মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে মাদারগঞ্জ থেকে থানা সরিয়ে ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে মাদারগঞ্জ ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম।
ময়মনসিংহ জেলা শহর হতে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে উচাখিলা বাজার অবস্থিত। পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনা হিসেবে উচাখিলা ইউনিয়ন পরিষদের থেকে মাত্র ২০০ গজের মধ্যে আট গম্বুজের পুরাতন জামে মসজিদ অবস্থিত। উচাখিলা-ঈশ্বরগঞ্জ-গাজীপুর রাস্তার উত্তর-পূর্ব পাশে গোল্লাজয়পুর গ্রামে একটি প্রাচীন নীল কুঠির ধ্বংশাবশেষ রয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে এই গ্রামে জরিপের সময় এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে মাদারগঞ্জ বিষয়ে কথা হয়। মাদারগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা মো. সামছুউদ্দিন (৮৫) বলেন, তিনি বাপদাদার কাছে শুনেছেন, মাদারগঞ্জে এক সময়ে থানা ছিল। তিনি আরও বলেন তিন চার কিলোমিটার দূরে বর্তমান ব্রহ্মপুত্র নদ এবং কাচামাটিয়া নদীর ব্রীজের ঐ পাড়ে উচাখিলা বাজার অবস্থিত।
মধুপুর (Modupour)
মধুপুর ছিল বিখ্যাত নদীবন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বাংলার প্রধান অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর মধ্যে এই বন্দরটি প্রাচীন ও মধ্যযুগেই বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত ছিল। জেমস রেনেলের মানচিত্রে মূল ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে মধুপুর অবস্থিত। ১৭৮৭ সালের আগে ব্রহ্মপুত্র নদটি ২০-২২ কিলোমিটার প্রসস্থ ও খরস্রোতা ছিল। তাছাড়া হোসেনশাহী পরগনায় অবস্থিত ছিল নদীবন্দরটি। বর্তমান মধুপুর শুধু গ্রাম, এখানে একটি বাজার আছে যা চৌরাস্তায় অবস্থিত। জেমস রেনেলের বইয়ের মানচিত্রের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে কলকাতা থেকে মধুপুর পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৭৩ মাইল। মধুপুর ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মগটুলা ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। ময়মনসিংহ জেলা শহর হইতে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে মধুপুর বাজার অবস্থিত। পুরাকীতি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনা হিসেবে মগটুলা ইউনিয়ন পরিষদের কাছে একটি প্রাচীন রাজবাড়ী রয়েছে।
জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোরের আমলে ঈশ্বরগঞ্জের উন্নয়ন
বিশ্বেশ্বরী দেবীর দত্তক পুত্র গ্রহণের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারের সময়ে ব্রজেন্দ্র কিশোর জমিদারির দায়িত্ব নেয়ার মতো বয়স হলে সম্পত্তির বিভাগ বিভাজন নিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবীর সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারিবারিক বিবাদ নিরসন হয়। মা-পুত্রের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল। ফলে গৌরীপুর জমিদারির সমস্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ (৮০ গন্ডা) বিশ্বেশ্বরী দেবীর হাতে ছিল এবং অপর তিন চতুর্থাংশ ব্রজেন্দ্র কিশোর সম্পত্তির অধিকারী হলেন। দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণের দশ বছর পর ব্রজেন্দ্র কিশোর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জমিদারির কার্যভার গ্রহণ করে অতি দক্ষতার সহিত কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে অল্পদিনের মধ্যেই লোকসমাজে সুনাম অর্জন করেন। যশ, মান, সম্মানের সঙ্গে তাঁর সম্পত্তিরও উন্নতি হতে লাগলো। বিভিন্ন জায়গায় জমিদারি কিনে পৈত্রিক সম্পত্তির পরিধি বাড়িয়েছিলেন। হাট-বাজার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন করেছিলেন। পানি চলাচলের জন্য খাল কাটা, পতিত জমিতে প্রজা বসতি স্থাপন করে সম্পত্তির উন্নতি সাধন করেছিলেন। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ প্রথম খণ্ড থেকে জানা যায় যে, বিশ্বেশ্বরী দেবী আজীবন সততার সঙ্গে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষিতা, মেধাবী, শিক্ষানুরাগী, ধার্মিক ও সমাজসেবক। এই গ্রন্থে বিশ্বেশ্বরীর তীর্থবাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই তিনি তীর্থস্থানে যাওয়ার আগে তাঁর সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ তাঁর ছেলে ব্রজেন্দ্র কিশোরের কাছে হস্তান্তর করেন এবং উক্ত সম্পদের অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁর স্বামীর নামে দেশের সবচেয়ে সুন্দর একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলে যান। মা’র আদেশ পালন করে জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১০ জুলাই ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর নামানুসারে গৌরীপুরে ১১ একর জমিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তীর্থস্থানে বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যুর পর জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তার মার নামে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শহরের কাঁচামাটিয়া নদীর কোলে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। তাছাড়া তিনি ১ জানুয়ারি ১৯২০ খ্রিঃ তাঁর মাতার নামানুসারে সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে বিশ্বেশ্বরী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যুর তথ্যটি ১৯১৭ সালে F. A. Sachse এর সম্পাদিত Bengal District Gazetteers' Mymensingh প্রকাশের মাধ্যমে জানা যায়। (Page-157) Jugal Kishor’s share descended through an adopted grand¬ son to Rajendra Kishor, who again died childless. His widow Bisveswari Debi enjoyed a fourth of the estate (Gauripur 4 annas) as a separate estate until her death a short time ago. Her adopted son, Brajendra Kishor, who brought the wellknown swadeshi case against Mr. Clarke, the Collector of the district, in connection with the Jamalpur riots in 1907, is the sole proprietor of the second 4 annas share. সুতরাং দেখা যাচ্ছে ১৯১৭ সালে গেজেটিয়ার প্রকাশের দুই- তিন বছর আগে বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যু হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ, সোহাগী ও আঠারবাড়ী রেল স্টেশন
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে তিনটি রেলওয়ে স্টেশন- ঈশ্বরগঞ্জ, সোহাগী ও আঠারবাড়ী। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির মাধ্যমে ১৮৮৫ সালে ময়মনসিংহের সঙ্গে ঢাকার রেল সংযোগ স্থাপন হয়। ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে গঠিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এদেশে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঈশ্বরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন, সোহাগী রেলওয়ে স্টেশন, আঠারবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন ১৯১২ থেকে ১৯১৮ সালে তৈরি করা হয় এবং ময়মনসিংহ- গৌরীপুর- ভৈরব লাইনের সাথে চালু হয়। ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেললাইন ছিল আসাম-বেঙ্গল রেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীনে। ঈশ্বরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন, ঈশ্বরগঞ্জ শহরে অবস্থিত ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেলপথের একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই রেলওয়ে স্টেশন হতে দক্ষিণ অবস্থিত বগাপোতা গ্রাম। ইতিহাস বলছে বগাপোতা কামরূপদের নামকরণ। বগাপোতা গ্রামটি এক সময়ে নদীর চর বা দ্বীপ ছিল। এই চরে অনেক বগা, বগলা অথবা বক পাখির বসবাস ছিল। কোন এক মহামারীতে অনেক পাখির মৃত্যু হলে এই চরে পাখিদের পোতে রাখা হয়েছিল তখন জায়গাটির নাম হয় বগাপোতা। গৌরীপুরের জমিদারদের অনুরোধে বগাপোতা গ্রামে সোহাগী রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা হয়। রেলওয়ে স্টেশনটির নামকরণ করা হয় বগাপোতা গ্রামের পাশ্ববর্তী গ্রাম সোহাগীর নাম দিয়ে । পরবর্তী সময়ে সোহাগী রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্র করে সোহাগী ইউনিয়ন পরিষদের নামকরণের সৃষ্টি হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ঐতিহ্য
নীলকুঠি: ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা গোল্লাজয়পুর গ্রামে নীলকুঠির ধ্বংশাবশেষ। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কাছে বাংলার শেষ নবাবের পরাজয়ের পর পর ইংরেজরা দল বেঁধে এ অঞ্চলে আসতে থাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের আশায়। নবাব সিরাজের পতনের পর ঈশ্বরগঞ্জর মাদারগঞ্জের কাছে নীলকুঠি গোড়াপত্তন হয়। নীলকুঠি নীল বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্মাণ করেছিল। গৌরীপুরের সংগঠনগুলোর উদ্যোগে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে এই গ্রামে জরিপের সময় এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে নীলকুঠি বিষয়ে কথা হয়। গোল্লাজয়পুর গ্রামের কুঠিবাড়ী বাসিন্দা রোমান আহমেদ (২৭) বলেন, নীলকুঠির ধ্বংশাবশেষ মধ্যে বর্তমানে দালানের ভিটাটা রয়েছে। ভিটার নীচে এখনোও দুই তিনটি কক্ষ রয়েছে। অন্ধকার কক্ষে অনেক শিয়াল বা ইতর প্রাণী বসবাস করছে। এক সময়ে এটি দোতলা কাঠামো বিশিষ্ট লম্বা দালান ঘর ছিল।মোমেনসিং পরগণার সীমানা খোঁজার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, গৌরীপুরের ১২টি জমিদার বাড়ির মধ্যে এখানে কালীপুর, ভবানীপুর, ও গৌরীপুর রাজবাড়ি জমিদারের রাজস্ব আদায়ের সীমানা রয়েছে। তাছাড়া নীলকুঠির থেকে ৭০/৮০ গজ দূরে রয়েছে চিত্রনাট্যকার ও কৌতুকাভিনেতা আশীষ কুমার লোহর জন্মস্থান ও বাবার বাড়ি।
ভূইয়া বাজার মঠ: ভূইয়া বাজার মঠ নামে পরিচিত। বর্তমানে ঐ জায়গায় কোন হাট বাজার নেই। ঈশ্বরগঞ্জ শহর নিকটবর্তী এলাকা ও কাচামাটিয়া নদীর তীরে ঐ স্থানটি অবস্থিত। শুধু মঠটি ইতিহাসের পাতায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বীর পাঁচাশী গ্রামের বাসিন্দা মো আব্দুল খালেক বলেন, তিনি বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন যে, এক সময়ে মঠের কাছে বাণিজ্যিক এলাকা এবং নদীবন্দর ছিল। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে মঠটি জরিপের সময় মঠের কাছে সরকারি জায়গায় বসবাসকারী ফুলজান(৭৮) বলেন ময়মনসিংহের বিশ্বজিৎ বাবু মাঝে মাঝে পূজার আয়োজন করে থাকেন এবং রবিদাস সম্প্রাদায় মঠটি দেখাশুনা করে থাকেন।
খানপুর গ্রামে দুটি মঠ: সরিষা ইউনিয়নে খানপুর গ্রামে দুটি মঠ রয়েছে।
আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি: নান্দাঈল উপজেলার সীমানা ঘেষাঁ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত কালের সাক্ষী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি। হোসেনশাহী পরগনার অংশে আঠারবাড়ী জমিদার বাড়িটি অবস্থান।
দরগাপাড়া: হারুয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে দরগা পাড়া নামে পরিচিত মধ্যযুগের মাজার রয়েছে।
রাজীবপুর জমিদার বাড়ি: উচাখিলা হতে মধুপুর যাওয়ার পথে রাজীবপুর জমিদার বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়।
ধীতপুর সর্দারবাড়ি: মগটুলা ইউনিয়নের ধীতপুর গ্রামে একটি সর্দারবাড়ির (রাজবাড়ি) ধ্বংশাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
মুঘল আমলের মসজিদ: খাজা উসমান খাঁ ও মুঘল আমলের বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছ। যেমন ঈশ্বরগঞ্জ বড় মসজিদ।
উচাখিলা প্রাচীন জামে মসজিদ: চরযিথর তিন গম্বুজ প্রাচীন জামে মসজিদ, জিগাতলা মুন্সিবাড়ি এক গম্বুজ প্রাচীন জামে মসজিদ, ভালুকবেড় উত্তর পাড়া এক গম্বুজ প্রাচীন জামে মসজিদ।
বিবিধ
১৮৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ৫৪টি ডাকঘর ছিল। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহে ৩টি প্রধান ডাকঘর, ৪৬টি সাব অফিস ও ১৪৭ ব্রাঞ্চ অফিস ছিল। যেমন- ২য় শ্রেণীর হেড অফিস শ্যামগঞ্জ, শম্ভুগঞ্জ, ডৌহাখলা; সাব পোস্ট অফিস- ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, রামগোপালপুর। ১৮৮০ সালে ঈশ্বরগঞ্জে ডাকঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ সালে টেলিগ্রাম চালু হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ৭ অক্টোবর ঈশ্বরগঞ্জে পৌরসভা গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
তথ্য সূত্র:
১. ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার— শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র)
২. ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ— শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
৩. ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব— মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা
৪. ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র
৫. সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে— ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে
৬. নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস— আলী আহম্মদ খান আইয়োব
৭. উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা – উইকিপিডিয়া (খ) কলকাতা – উইকিপিডিয়া (৮) বাংলাপিডিয়া
(৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ এরং ২০২৩ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ) (১১) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন – দরজি আবদুল ওয়াহাব (১২) ময়মনসিংহের রাজপরিবার – আবদুর রশীদ। (13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal (14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton (15) The History of British India- James Mill (16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation). (17) David Rumsey Historical Map Collection. (18) New York Historical Society. (19) ১৯১৭ সালে F. A. Sachse এর সম্পাদিত Bengal District Gazetteers' Mymensingh (20) ১৯০৫ সালে প্রকাশিত MYMENSINGH DISTRICT GAZETTEER. STATISTICS, 1901-02.
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী
[email protected]
এসবিডি/এবি
মন্তব্য করুন: