চুয়াডাঙ্গায় শীতের আগমনী বার্তা, খেজুর গাছ প্রস্তুতে ব্যস্ত গাছিরা
ছবি: সময়বিডি.কম
চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন গ্রামে একসময় খেজুর গাছে ভরপুর ছিল। শীত আসলেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গাছিরা। বিকেল হলেই গাছে হাঁড়ি টানাতেন আবার সকাল হলে রস সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলতো গুড় আর পাটালি তৈরির কাজ। খেজুরের গুড় আর পাটালির মৌ মৌ গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াতো। কেউ কেউ রস বিক্রি করতেন আবার কেউ স্বজনদের বাড়িতেও পাঠাতেন। কালের বিবর্তনে এসব এখন ইতিহাসের পাতায় জড়ো হচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে গাছ।
এদিকে প্রকৃতিতে বইছে শীতের আগমনী বার্তা। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রকৃতি। একইসঙ্গে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলার গাছিরাও। এ বছর এ জেলা থেকে ৩৫ কোটি টাকার ওপরে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সুস্বাদু এ গুড় নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে সরবরাহ করা হবে।
ইতোমধ্যে গাছিরা হাতে দা আর কোমরে দড়ি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাঁছাছোলা ও নলি বসানোর কাজ করছেন। ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি বেঁধে গাছে ঝুলে রস সংগ্রহের কাজ করেন গাছিরা। প্রতিদিন বিকেলে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি গাছে বাঁধা হয়। আর সকালে রস সংগ্রহ করা হয়। কেউ কেউ কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস দিয়ে গুড় তৈরি করেন।
শীত মৌসুম এলেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বত্র শীত উদযাপনের নতুন আয়োজন শুরু হয়। খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ অঞ্চলের গাছিরা। তাদের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। শীতের দিন মানেই খেজুর রস ও নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধ। শীতের সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে বোঝানো যায় না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো খুবই মজাদার। এ কারণে শীত মৌসুমের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের পায়েস ও পিঠে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়িতে খেজুর রসের তৈরি খাদ্যের আয়োজন চলে। শীতের সকালে বাড়ির উঠানে বসে সূর্যের তাপ নিতে নিতে খেজুরের মিষ্টি রস যে পান করেছে, তার স্বাদ কোনো দিন সে ভুলতে পারবে না। শুধু খেজুরের রসই নয় এর থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি, গুড় ও প্রাকৃতিক ভিনেগার। খেজুর গুড় বাঙালির সংস্কৃতিক একটা অঙ্গ। নলেন গুড় ছাড়া আমাদের শীতকালীন উৎসব কল্পনাই করা যায় না। এখনও শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রামে খেজুর রস খেতে। কয়েক দিন পরই গাছিদের মাঝে খেজুর গাছ কাটার ধুম পড়ে যাবে।
জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের আনোয়ার মল্লিকের ছেলে কাদের মল্লিক বলেন, ১০ দিন হয়েছে কাজ শুরু করেছি। গাছের ময়লা ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ধারালো দা দিয়ে খেজুর গাছের সোনালী অংশ বের করে নলি স্থাপনের কাজও প্রায় শেষ। কিছুদিন পরই গাছে লাগানো হবে মাটির পাতিল। এর পরই শুরু হবে সুস্বাদু খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। তা দিয়ে তৈরি হবে গুড় ও পাটালি।
তিনি আরও বলেন, এক কেজি গুড় তৈরি করতে খরচ হয় ৯০-১০০ টাকা। আর বিক্রি করতে হয় ১২০-১৩০ টাকা দরে। যে কারনে চাষিরা গুড় বানাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
দেহাটি গ্রামের গাছি লিয়াকত হোসেন জানান, শীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস। আর সপ্তাহ দুইয়েক পর গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর্ব শুরু হবে। তার নিজের রয়েছে ৪০টি গাছ। আরও ৪০টি গাছ তিনি বর্গা নিয়েছে। গাছ একবার ছাঁটলে তিন-চার দিন রস সংগ্রহ করা যায়।
কাটাপোল গ্রামের গাছি আবু তালেব বলেন, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে তাতে এক সময় হয়তো আমাদের দেশে খেজুর গাছ থাকবে না। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত তালগাছের মতো বেশি বেশি খেজুর গাছ লাগানো এবং তা যত্ন সহকারে বড় করা।
যাদবপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেন বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার খেজুর গাছের রস হতে উৎপাদিত গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর গ্রাম থেকে ট্রাক ভর্তি গুড় দেশের বিভিন্ন যায়গায় রপ্তানি হয়ে থাকে। গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্য খেজুর রস ও গুড় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার কারনে আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিদিন ইটভাটায় জ্বালানির কাজে নিধন হচ্ছে এলাকার শত শত খেজুর গাছ। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর পরও গাছিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, আর মাত্র কয়েকদিন পরই গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হবে। রস থেকে গুড় তৈরির পর্ব শুরু হয়ে চলবে প্রায় ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। হেমন্তের প্রথমে বাজারগুলোতে উঠতে শুরু করবে সুস্বাদু খেজুরের পাটালি ও গুড়।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান সরকার জানান, জেলায় এ বছর রস সংগ্রহের জন্য ২ লাখ ৭২ হাজার খেজুর গাছ প্রস্তুত করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে এসব গাছ থেকে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন।
তিনি বলেন, সারা দেশেই এ জেলার গুড়ের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। এবারও আশাকরি জেলায় গুড়ের চাহিদা মিটিয়ে খেজুরের গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে জায়গা করে নিবে। শীতকালীন মৌসুমি এ পেশায় জেলার প্রায় ৩০ হাজার চাষি সম্পৃক্ত রয়েছে।
এসইউকে/এসবিডি/এবি/
মন্তব্য করুন: