প্যালিয়েটিভ কেয়ারে প্রয়োজন টেকসই ও সাংস্কৃতিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা ব্যবস্থা
প্রতীকী ছবি
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন-সীমিতকারী রোগে আক্রান্ত কোন অসুস্থ ব্যক্তির জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনাগুলো যখন আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে প্রবেশাধিকারের উন্নতি করতে পারলে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের জীবনের মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত সম্ভব। অনেকের জন্য, গুরুতর অসুস্থতার সময় চিকিৎসার পরিবর্তে জীবনমানের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন হয়। এখানে প্যালিয়েটিভ কেয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, এবং সামাজিক প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করে।
তবে একটি বড় বাধা রয়েছে – সেবায় প্রবেশাধিকার! অনেক রোগী পর্যাপ্ত প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা পায় না, যার ফলে তাদের অযথা কষ্ট ভোগ করতে হয় এবং একটি পূর্ণ জীবনের সম্ভাবনাগুলো দ্রুত হারিয়ে যায়।
বিশ্ব হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস (WHPCD) ২০২৪ সামনে রেখে, গ্লোবাল হেলথ কমিউনিটি বিগত দুই দশকে বৈশ্বিকভাবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিগুলো নিয়ে কাজ করছে, পাশাপাশি প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবায় এখনও যে চলমান ঘাটতিগুলো রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করছে। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার পালিত এই বার্ষিক দিনটি। যা আমাদের যৌথ দায়িত্বের অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। যার উদ্দেশ্য জীবন-সীমিতকারী অসুস্থতার সম্মুখীন ব্যক্তিরা যেন সহানুভূতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ সেবার অভাবে না ভুগে। এই বছরের প্রতিপ্রাদ্য, “প্রস্তাবের ১০ বছর: আমরা কতখানি অগ্রসর হয়েছি?” এটি শুধুমাত্র একটি আহ্বান নয়, বরং স্বাস্থ্যসেবার সকল অংশীদারদের জন্য নিজেদের অর্জন-সীমাবদ্ধতাকে পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের সুযোগ।
২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ (WHA) এর প্রস্তাব থেকে এই প্রতিপাদ্যটি প্রেরণা হিসেবে নেওয়া হয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য নীতির জন্য একটি মাইলফলক ছিল। এই প্রস্তাব সব সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানিয়েছিল যে, প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে পুরো জীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ সেবার একটি উপাদান হিসেবে শক্তিশালী করতে হবে। এর অর্থ হলো প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে জাতীয় স্বাস্থ্য কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে সকল স্তরে এ সেবা প্রদান করা যায়। সেই সাথে রোগীর যে কোন ধরণের উপসর্গ ব্যবস্থাপনা, ব্যথা মুক্তি এবং মানসিক সহায়তার বিষয়টি যেন প্রাধান্য পায়। এটি স্বীকৃত যে, প্যালিয়েটিভ কেয়ার শুধুমাত্র জীবনের শেষ মুহূর্তের একটি সেবা নয়, বরং এটি স্বাস্থ্যসেবার একটি অপরিহার্য অংশ, যা অনিরাময়যোগ্য রোগ নির্ণয়ের সময় থেকেই শুরু হওয়া উচিত এবং রোগীর মৃত্যুর পরও পরিবারগুলোর জন্য স্বজন হারানোর শোক মোকাবেলায় অব্যাহত থাকা উচিত।
অনেক উন্নত দেশে এই প্রস্তাবটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্য একটি চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা প্রসারিত হয়েছে, সচেতনতা বেড়েছে, এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো জোরদার হয়েছে। তবে, নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে (LMICs) যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের গুরুত্ব সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা সত্ত্বেও, লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশের প্যালিয়েটিভ কেয়ার চাহিদা: একটি কঠিন বাস্তবতা
বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবার চাহিদা অত্যন্ত বেশি। বিশ্বব্যাপী বছরে ৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন, এবং এই চাহিদার একটি বড় অংশ নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে রয়েছে। বৈশ্বিক চাহিদার পাশাপাশি বাংলাদেশে এই প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, দেশে মাত্র ছয়টি পূর্ণাঙ্গ প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা কেন্দ্র রয়েছে, যা শুধুমাত্র ঢাকায় অবস্থিত। সেবাগুলির এই ভৌগোলিক কেন্দ্রীকরণ একটি গভীর বৈষম্যকে নির্দেশ করে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য, যারা দেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজনীয় সেবা পায় না।
প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রবেশাধিকারের প্রয়োজনীয়তা:
বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এটি একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন কোন মানুষ গুরুতর অসুস্থতার মুখোমুখি হয়, তখন প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা দেওয়ার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার শুধুমাত্র জীবনের শেষ পর্যায়ে সহায়তা নয়; এটি রোগীদের এবং তাদের পরিবারের জীবনমান উন্নত করার জন্য একটি সামগ্রিক পদ্ধতি। তবে, এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো সমান প্রবেশাধিকার নেই। সচেতনতার অভাব, আর্থিক সমস্যা এবং প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের অভাবের মতো প্রতিবন্ধকতাগুলো এই সেবার বিস্তৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। রোগীদের সুস্থতার ওপর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের গভীর প্রভাব বিবেচনায় রেখে, এই বাধাগুলো দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে রোগী এবং তাদের পরিবার প্রয়োজনীয় সহায়তা ও স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারে। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রবেশাধিকারের উন্নতি শুধু স্বাস্থ্যসেবার অগ্রাধিকার নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব। যা গুরুতর অসুস্থতার মুখোমুখি ব্যক্তিদের মর্যাদা ও সার্বিক মঙ্গল রক্ষা করতে সহায়তা করে।
প্রবেশাধিকারের বাধা দূর করা:
প্যালিয়েটিভ কেয়ার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব একটি বড় বাধা। দেশব্যাপি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও সাধারণ জনগণকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের উপকারিতা ও এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ভুল ধারণা দূর করে এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ব্যাপারে সঠিক ধারণা গড়ে তোলা হলে এই সেবার গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। আর্থিক সীমাবদ্ধতাও একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবার ব্যয় বহন করার উপর নির্ভর করে, সেবাটি যে কোন মানুষ নিতে পারবে কি না। সরকার, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এবং নীতি-নির্ধারকদের একসঙ্গে কাজের মাধ্যমে এমন একটি টেকসই কর্ম কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন সামাজিক বা আর্থিক অবস্থার পার্থক্য ছাড়াই যে কেউ প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা পেতে পারেন।
টেকসই প্যালিয়েটিভ কেয়ার কাঠামো:
প্যালিয়েটিভ কেয়ারের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলায়, একটি টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যালিয়েটিভ কেয়ার কাঠামো প্রয়োজন। প্রথম পদক্ষেপ হবে নীতিগত উন্নয়ন। বাংলাদেশকে দ্রুত একটি জাতীয় প্যালিয়েটিভ কেয়ার নীতি এবং কৌশল তৈরি করতে হবে, যা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার (UHC) লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় প্যালিয়েটিভ কেয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হলে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা তাদের নিজ এলাকায় প্রাথমিক সেবা পেতে পারবে। প্রয়োজনের সময় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ঢাকায় আসার প্রয়োজন পড়বে না। যদি জেলা হাসপাতাল এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এই সেবা প্রদান করা যায়, তাহলে তা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হবে।
সংস্কৃতিগত অন্তর্ভুক্তিমূলকতা: কার্যকর সেবার চাবিকাঠি:
বাংলাদেশের সংস্কৃতিগত বিশ্বাস এবং সামাজিক নিয়মগুলি মৃত্যুর বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই, প্যালিয়েটিভ কেয়ার কার্যকর করতে হলে সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল একটি দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করা জরুরি। ধর্মীয় নেতারা, যারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেন, তাদেরকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের সমর্থনে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য গণমাধ্যমেরও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নাটক, সংবাদপত্রে প্রতিবেদন-ফিচার, আর সোশ্যাল মিডিয়ার উপযুক্ত কন্টেন্টের মাধ্যমে মানুষকে মৃত্যুর বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। এতে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সহজ হবে এবং পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদেরকে সেবা দেওয়ার উপায়গুলো জানবে।
ব্যথা ব্যবস্থাপনা ও ওষুধের প্রাপ্যতা:
বাংলাদেশের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যথা নিরাময়ের জন্য ওষুধ, বিশেষ করে মরফিনের মতো অপিয়য়েডগুলির সীমিত প্রাপ্যতা। এখনই এই ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, যাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী মরফিনের মতো অপরিহার্য ওষুধগুলি সহজলভ্য হয়।
সম্মিলিত আহ্বান
এবার বিশ্ব হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস (WHPCD) এর ২০ বছর পূর্তি। এখনই সময় সরকার, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের এবং সুশীল সমাজকে একত্রিত হয়ে একটি টেকসই প্যালিয়েটিভ কেয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলার, যেখানে প্রতিটি মানুষের জীবনকে মর্যাদা দেওয়া হবে।
প্যালিয়েটিভ কেয়ারে গত এক দশকে বিশ্বব্যাপি অনেক অগ্রগতি হলেও যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যাদের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন, তাদের সকলের জন্য এই সেবা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে এখনও বড় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই দিবস উপলক্ষে আমরা যতদূর এসেছি, তার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করা জরুরি, কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই কাজগুলোকে স্বীকার করা, যা এখনো গৃহীত হয় নি। প্যালিয়েটিভ কেয়ারে সবার জন্য সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের আরও অনেক পথ চলা বাকি। আসুন, ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করি, অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখি।
লেখক: সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্য কর্মী ও প্রশিক্ষক
ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন: