বন্যায় ভাসছে শেরপুর জেলা ও ময়মনসিংহের ২ উপজেলা
ছবি: সময়বিডি.কম
ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে শেরপুর জেলা। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যায় নিম্নাঞ্চলে পানি বেড়েই চলেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত দু’দিনে বানের পানিতে ডুবে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যায় বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। ডুবে গেছে দুই শতাধিক গ্রাম। তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। দেখা দিয়েছে খাবার সংকট।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেকে বিপাকে পড়েছেন। প্রধান সড়কের আশপাশে সহযোগিতা পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট।
নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছানোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, মৃতদের মধ্যে শুক্রবার রাতে নালিতাবাড়ী উপজেলার বাঘবেড় বালুরচর গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী ওমিজা বেগম ও খলিসাকুড়া গ্রামের বৃদ্ধ ইদ্রিস আলীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিন দুপুরে উপজেলার অভয়পুর গ্রামে পানির তোড়ে নিখোঁজ হন দুই ভাই হাতেম আলী ও আলমগীর। শনিবার বিকেলে কুতুবাকুড়া গ্রামের ধানক্ষেত থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আরও একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
অন্যদিকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সজল কুমার রায় বলেন, শেরপুরে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর পানি আরও কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। দুটি নদী ছাড়া দেশের সব নদ-নদীর পানি বর্তমানে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।
শেরপুরের তিন উপজেলায় এখনও অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন আবাদ, মাছের ঘের ও সবজি। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর মহারশি ও ভোগাই নদীর অন্তত ১০ জায়গায় বাঁধ ভেঙে ও পাড় উপচে প্লাবিত গ্রামের বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও ফসল তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে ধসে ও ভেসে গেছে ঘরবাড়ি। পানি উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে। এসব এলাকায় কিছু আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, গত ৩৬ বছরে এমন বন্যা দেখেননি।
বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, নকলা, শ্রীবরদী এবং শেরপুর সদরের অন্তত ৪০টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রাম।
পানির তোড়ে শেরপুর-তিনআনী-নালিতাবাড়ী আঞ্চলিক সড়ক ভেঙে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শনিবার দুপুরে রানীগাঁও এলাকায় সড়কটি ভেঙে যায়। এ কারণে দুর্গত এলাকায় যেতে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করতে হচ্ছে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে।
শেরপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম বলেন, অনেক সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো আপৎকালীন সময়ে মেরামতযোগ্য সেগুলো কাজ করা হচ্ছে।
এদিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান চলছে। তবে পানির প্রবল স্রোত আর পর্যাপ্ত নৌযানের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধারকাজ।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, নালিতাবাড়ী পৌরসভা, কাকরকান্দি, বাঘবেড়সহ প্রায় সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এসব জায়গার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উদ্ধারকাজ চলমান।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্তত ২০ হাজার হেক্টর আমন এবং দেড় হাজার হেক্টর সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার বলেন, ঝিনাইগাতী সদর, নলকুড়া, গৌরীপুর, নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া এবং নালিতাবাড়ী সদর ইউনিয়নের সব খামারের মাছ ভেসে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাকিবুজ্জামান খান জানান, শনিবার সকালে ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভোগাই, চেল্লাখালী ও ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর বেশ কয়েকটি স্থানে দুই পাড় ও তীর রক্ষার বাঁধ ভেঙে গেছে। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন ঠোকানোর চেষ্টা চলছে।
তিন উপজেলায় বন্যাকবলিত ৮৫০ জনকে উদ্ধার এবং খাবার সরবরাহ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়নের (৩৯ বিজিবি) সদস্যরা ত্রাণ সহায়তা তুলে দেন।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, দুর্গতদের উদ্ধারে ও তাদের কাছে শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে।
ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে অন্তত ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভেসে গেছে ঘেরের মাছ। ডুবে গেছে প্রায় চার হাজার হেক্টর জমির ফসল।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হালুয়াঘাট সীমান্তবর্তী চারটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি উপচে দর্শা, মেনংছড়া, বোরারঘাট ও শেওলা নদীর তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রাতেই বিভিন্ন স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে প্রবল বেগে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।
হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ বলেন, উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। চারটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। এমন ৩০টি পরিবারের তথ্য পেয়েছি। তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল জানান, দুটি উপজেলায় অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সেসব জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এসবিডি/এবি
মন্তব্য করুন: