রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প: বিশ্বকে চমকে দিতে চায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে করোনাভাইরাসের মরণ থাবাও থামাতে পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অগ্রগতি। এরইমধ্যে প্রকল্পের ৫০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশায় গত বছরের ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আানুষ্ঠানিকভাবে প্রেসার ভেসেল স্থাপনের উদ্বোধন করেন। এই ভেসেলকে বলা হয় পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘হার্ট বা হৃৎপিণ্ড’। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করায় ৩৩টি দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন তালিকায় বাংলাদেশ আরো একধাপ এগিয়ে যায়। বিশ্বতালিকায় যোগ হয়ে চমকে দিতে চায় বাংলাদেশ।
প্রথম ইউনিট চালুর পরের বছরই অর্থ্যাৎ আগামী ২০২৪ সালেই দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার ৬ থেকে ৮ মাস পর এই ইউনিট থেকেও এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রেডে সরবরাহ করা হবে।
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের মধ্যে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প। এক লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকাই ঋণ সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া।
অবস্থান:
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে প্রকল্পটি নির্মিত হচ্ছে। পদ্মার তীরঘেষা আলোচিত এই প্রকল্পের পাশেই রয়েছে মহান স্বাধীনতা স্মৃতিবিজরিত ও ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহাসিক স্থাপনা পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং দেশের অন্যতম বৃহত্তর লালন শাহ সেতু। মোট এক হাজার ৩৪৬.৬৪ একর জমিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে।
জনবল:
আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি এটি পরিচালনার জন্য জনবলও দিচ্ছে দেশটি। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের মধ্যে অর্ধেকই রাশিয়ান। তাছাড়া, ভারত, ইউক্রেন, বেলারুশ, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ ১৫টি দেশের সোয়া ৫ হাজারের বেশি মানুষ এখানে কাজ করছেন। এরমধ্যে রাশিয়ানদের সংখ্যাই তিন হাজার ৮০০। প্রকল্প শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ জন রাশিয়ান নাগরিক মারা গেছেন। এ ছাড়াও এই প্রকল্পে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যেও ৭-৮ জন বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে মারা গেছেন।
নিরাপত্তা:
প্রকল্পটি দেশিয় ও আন্তর্জাতিক সকল বাধ্যবাধকতা বিবেচনায় নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। মনুষ্য-সৃষ্ট কোনো দুর্ঘটনা বা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভুমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে এমন যে কোনো বিপর্যয় মোকাবেলায় সক্ষম ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর বিপুল সদস্যদের মাধ্যমে কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকল্পটিকে নিরাপত্তা দিতে চালু হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভৌত সুরক্ষা ব্যবস্থা (পিপিএম) নির্মাণ প্রকল্প। হাইয়েস্ট ন্যাশনাল সিকিউরিটি দিতে তিন হাজার ৪৪৯ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে রাশিয়ান একটি টিম কাজ করে। রাশিয়া ও বাংলাদেশ যৌথভাবে এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।
নিরাপদ ও সুরক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবেশের পাশাপাশি তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সংবেদনশীল তথ্য ব্যবস্থাপনা এই প্রকল্পে রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভ্যাসেল স্থাপনের পর জ্বালানি আনার বিষয়টিই হবে সবচেয়ে বড় কাজ। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গাইডলাইন মেনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পরমাণু জ্বালানি আনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করবে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে জ্বালানি আসার পর তা সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় পাবনার বেস স্টেশনে নেয়া হবে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই পরমাণু জ্বালানি আনা হতে পারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ কাজের ভারি মালামাল প্রকল্প এলাকায় পৌঁছানোর জন্য ২২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৯ কোটি টাকা। পৃথক এ রেললাইন ঈশ্বরদী বাইপাস টেক অব পয়েন্ট থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র পর্যন্ত যাবে। মালামাল পরিবহনে নৌপথকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ভারি যন্ত্রপাতি চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আনার পর নৌপথে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছানো সহজ ও নিরাপদ হবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশিষ্টরা। এজন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে রূপপুর, পাকশী পর্যন্ত নৌপথের মাধ্যমে প্রকল্পের মালামাল সুষ্ঠুভাবে পরিবহনের জন্য নেভিগেশন চ্যানেল মার্কিং করতে বলা হয়েছে।
গ্রিনসিটি আবাসন:
প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে ৩৭.৫৬ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। গণপূর্ত অধিদপ্তর এ কাজ বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যেই ১৬টি সুউচ্চ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ তলা ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬ তলা ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। মোট ২২টি সুউচ্চ ভবন তৈরি হবে এ চত্বরে। এই প্রকল্পটি ঘিরে ইতোমেধ্য সেখানে গড়ে উঠেছে নতুন শহর।
যেভাবে শুরু:
স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬১ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরের বছরে ১৯৬২ সালে রূপপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান নির্ধারণ করা হয়। তবে জমি অধিগ্রহণ ও খুব অল্প পরিমাণে অবকাঠামো নির্মাণের পর প্রকল্পটি বাতিল করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবারো নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) সফরের সময় দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নুপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার অনুরোধ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়া আবারো থেমে যায়।
প্রায় ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া। এরপর প্রক্রিয়া আগাতে থাকলেও ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এই কার্যক্রম আবার হোঁচট খায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। ২০০৯ সালে জমি অধিগ্রহণসহ কিছু অবকাঠামো উন্নয়নের পর ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অ্যাক্ট পাস করা হয়। এরপর অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে বিশাল এই কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন করেন। এর পরই দ্রুত গতির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে প্রকল্পটি।
প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনায় আমাদের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ড. সৌকত আকবরের নেতৃত্বে প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির মধ্যেও আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চলছে। কোনো কাজ থেমে থাকেনি।’
২০২৩ সালেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘এখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে দেশের জন্য উন্নয়নের বিশাল পরিবর্তন শুরু হয়ে যাবে। কারণ, একটা দেশে বিদ্যুতের বিষয় নিরবিচ্ছিনতা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে শিল্প থেকে শুরু করে কৃষিসহ আর্থসামাজিক উন্নতি হতে বাধ্য।’
এমন একট স্পর্শকাতর প্রকল্পটি বর্তমান দেশপ্রেমিক সরকার হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে। এতো বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার সৎসাহস সবার থাকে না বলে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, ‘এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের দেশ পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে এটাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। রূপপুরের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্যুতের খাতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
জুন ৭, ২০২২
কেএস/এডিবি/
মন্তব্য করুন: