আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে ঈদের তাৎপর্য
মুসলিম সম্প্রদায়ের দুটি বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর আরবি শব্দ। এর অর্থ রোজা ভাঙার দিবস। আর ঈদুল আজহা মানে কুরবানির ঈদ। এই দুই ঈদের দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের নিকট বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ হলেও ঈদুল ফিতর আমাদের কাছে নানাদিক থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলো ঈদুল ফিতরের পূর্বে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা। এই একমাস মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও যথাযথ ধর্মীয় ভাবধারার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে। এ মাসশেষে অনাবিল খুশি, আনন্দ ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের বারতা নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনটি। এই দিনটিতে ছোট-বড়, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজার মধ্যকার সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে মিলিত হয় মুসলিম সম্প্রদায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঈদুল ফিতরের দিনটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এ দিনটি রোজার ঈদ হিসেবে পরিচিত।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন দুটি বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা মহিমান্বিত। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-
- পবিত্র রমজান মাসশেষে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা স্বাপেক্ষে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়।
- কোনো ময়দানে বা বড় মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এই জামাতে ছয় তাকবিরের সাথে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজ মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।
- প্রতি শুক্রবার জুমুয়ার দিনে ইমাম সাহেব যেমন নামাজের পূর্বে খুৎবা দিয়ে থাকেন, তেমনি ঈদের নামাজে খুৎবা দেয়া হয় নামাজের পর। খুৎবা দেয়া ইমাম সাহেবের জন্য সুন্নত আর খুৎবা শোনা নামাজীদের জন্য ওয়াজিব।
- ঈদের দিনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নামাজ পড়তে যাওয়া ও আসার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করা। সাধারণত মুসুল্লিরা যে পথ ধরে নামাজ পড়তে যান, নামাজশেষে অন্য পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।
- ঈদের নামাজ পড়তে যাবার আগে গোসল করা, নতুন কাপড় পরা, সুগন্ধিমাখা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়।
- নামাজশেষে পরষ্পরের সাথে কোলাকুলি করা এবং ঈদ মুবারক বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা ঈদের দিনের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক।
- মুসলমানদের জন্য এই দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ বা হারাম।
- মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, ঈদের দিন নামাজ পড়তে যাবার পূর্বে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া পূণ্যের কাজ। তবে কুরবানির ঈদের দিন নামাজ পড়তে যাবার আগে কিছু না খেয়ে যাওয়া সুন্নত।
- ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে প্রত্যেক সামর্থবান মুসলিমকে তার উপর নির্ধারিত ফিতরা পরিশোধ করতে হয়। এটা ওয়াজিব। রমজান মাসের রোজার ভুল-ত্রুটি কাটানোর জন্য ইসলাম এই বিধান চালু করেছে। উল্লেখ্য যে, কেউ ঈদের নামাজের পূর্বে কোনো কারণে ফিতরা আদায় করতে ভুলে গেলে নামাজের পরও এই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে ইসলামে।
- শিশুদের বেলায় ঈদের সালামি বা ঈদী (গুরুজনদের দেয়া অর্থ) পাওয়া বিশেষ আনন্দের বিষয়। তাছাড়া পাড়া-প্রতিবেশিদের ঘরে বেড়াতে যাওয়া এবং সেখানে কিছু খাওয়া ঈদের দিনের আনুষ্ঠানিকতাগুলোর মধ্যে একটি।
- ঈদুল ফিতরের দুই মাস দশ দিন পর অর্থাৎ জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ।
- কুরবানির ঈদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পশু কুরবানি করা। সামর্থবান মুসলমানদের উপর এটা ওয়াজিব।
কিন্তু আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে, ঈদ মানে শুধু আনন্দ করা নয়, শুধু আনুষ্ঠানিকতা পালন করা নয়। প্রতিটি ঈদ থেকে আমাদের জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু শিক্ষণীয় দিক। ঈদুল ফিতরের কথাই ধরা যাক। এই দিনটির সাথে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে পবিত্র রমজান মাস। রমজান মাসের প্রতিটি দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেহরি খাওয়া, ইফতারি করা, তারাবির নামাজ পড়া, সারাদিন যে কোনো পাপ কাজ থেকে নিজকে বিরত রাখা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করা - এই আনুষ্ঠানিকতাগুলো যথাযথভাবে পালন করার উদ্দেশ্য হলো নিজকে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমী করে তোলা। কিন্তু বাস্তবে আমরা সবাই কি তা করছি? অনেকে রোজা রাখে কিন্তু এক ওয়াক্ত নামাজও আদায় করেনা, রোজা রেখে অন্যের অমঙ্গল চিন্তা করে, ক্ষতিসাধন করে। এই রোজার মাসে যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায়, ওজনে কম দেয়, অন্যায়ভাবে খাদ্যপণ্য মজুদ করে বাজারে দাম বাড়ায়, মিথ্যে কথা বলে, চুরি-ছিনতাই করে, তাদের রোজার কি আদৌ কোনো মাহাত্ন্য আছে?
ইসলাম বলে, এসব মানুষের রোজা রাখা না রাখা একই কথা। ইসলাম যে কারণে আমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করেছে, এ শ্রেণির লোকদের বেলায় রমজানের এই মর্যাদা কোনভাবেই প্রতিপালিত হচ্ছে না। অথচ আমরা পারি রমজানের মাহাত্মকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে আমূল বদলে ফেলতে। তেমনিভাবে ঈদের দিন আমরা যেমন ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজার ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে এসে আনন্দে মেতে উঠি, কিন্তু আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে বাকি সময় আমরা এই চর্চা করি না। তাহলে ঈদের দিন থেকে আমরা কি শিক্ষা নিলাম?
একইভাবে কুরবানির ঈদে পশু কুরবানি দেয়ার মাধ্যমে নিজের মনের পশুটাকে কুরবানি দেয়ার কথা বলা হয়েছে ইসলামে। কিন্তু কার্যত কি আমরা সেটা করি ? আজকাল কুরবানি দেয়াটা অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে চলে গেছে। কে কত বড় এবং কত বেশি পশু কুরবানি করল সেটা দেখানোই কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ রকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাবে। এই লেখার পরিধি অহেতুক বৃদ্ধি করতে চাইনা বলে এ সংক্রান্ত আর কোনো উদাহরণ এখানে টানছি না। তবে শেষ করবো দুটো কথা বলে। আমরা বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, নিজেদের ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা আমাদের আছে। পবিত্র রমজান মাস, ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আজহার মাহাত্ম থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষমতা যেমন আমাদের আছে, এই দায়িত্বটাও তেমনি আমাদের। আমরা যতদিন না এটা করতে পারব ততদিন পবিত্র রমজান মাস, ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আজহার দিনগুলো শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, যা ইসলামী বিধি-বিধানের বিরোধী।
মুসলিম হিসেবে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। শুধুমাত্র এই কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমেই আমরা একজন সত্যিকার আদর্শবান মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিপন্ন করতে পারি। আজ থেকে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার, আমরা ইসলামী বিধি-বিধানসমূহকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে না রেখে প্রাত্যাহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাব।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার
মন্তব্য করুন: