• ঢাকা

  •  রোববার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

মত-অমত

অনালোচিত রবীন্দ্রনাথ

শাফায়াত স্বচ্ছ

 প্রকাশিত: ১৯:০৮, ৭ আগস্ট ২০২২

অনালোচিত রবীন্দ্রনাথ

মৃত্যুর একাশিটি বছর। অথচ এমন একটি দিন নেই, যেদিন তাঁকে নিয়ে কোথাও আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা হচ্ছে না। কি তাঁর সাহিত্য, কি তাঁর সমাজ দর্শন, রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত প্রশ্নাবলী কিংবা দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের মহানুভবতা - বড় বড় ডক্টরেট ঠাসা বোদ্ধা-বুূ্দ্ধিজীবীদের টেবিল গরম আলোচনায় ঋদ্ধ আমরা, ঋদ্ধ রবীন্দ্রনাথ নিজেও(!)। তবুও, এতসব ভারি আলোচনার মধ্যেও হারিয়ে গেছে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ। কাজেই বলি, অনালোচিত, অস্পৃশ্য অংশটুকুই প্রকৃত মানুষ রবীন্দ্রনাথ। 

নিম্নশ্রেণী মানুষ থেকে তাঁকে দূর হতে বাধ্য করেছিল তাঁর বংশীয় পরিচয়। এই ক্ষোভটুকু শেষ দিনগুলোয় তিনি উগরে দিয়েছিলেন কতো অদ্ভুত সৌন্দর্যে৷ ঐকতান কবিতায় কবিগুরুর অকপট স্বীকারোক্তি, 

‘জীবনে জীবন যোগ করা,
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা। 
তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা
আমার সুরের অপূর্ণতা।’

ঘরজামাই যখন আদরের মেয়ে মীরাকে দরজা বন্ধ করে মারত, তখন দরজার বাইরে পায়চারি কান্নাকাটি করতেন মহীধর মানুষটি। বিশ্বসাহিত্য যাঁর নিয়ন্ত্রণে, তাঁর হাতে নেই স্বীয় কন্যার অধিকার! নির্যাতন থেকে মীরার মুক্তিতে তাই তার মৃত্যু কামনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

তথাপি, এই পরিচয় কি তাঁকে বাঁধতে পেরেছে? অতি অবশ্য না। কারণ? ঢুঁ মারা যাক।

বিংশ শতাব্দীর ভারতে জমিদার মানেই সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। ক্ষমতার স্বেচ্ছাচার আর অত্যাচারের সীমায় যমদূত ছাড়িয়ে যায়। সেখানে রবিঠাকুর কে?

তিনি এমন এক ব্যক্তিত্বহীন জমিদার, যিনি প্রাসাদ ছেড়ে রোদে দাঁড়িয়ে কৃষকের ধান চাষ করা দেখছেন। যিনি চারপাশে ছোট ছোট মলিন বদন ছেলেপুলেদের নিয়ে মাঠের মধ্যে খেতে বসেছেন। যিনি মাঝির গলায় গান শুনতে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজের কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। সত্যেন্দ্র ঠাকুরের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবা জমিদারের ছেলে জমিদার হবে, এমনটা না ভেবে পুত্রকে কৃষিবিদ বানিয়ে তাকে মাঠের কৃষকদের ভাগ্য বদলে বাজি ধরেছেন! শুধু তাই নয়, অনাবৃষ্টির পর খাজনা মকুফ করে উল্টো প্রণোদনা দিয়ে বসেছেন! ইংরেজদের খাজনা মিটিয়েছেন নিজ কোষাগার ফাঁকা করে! বলা বাহুল্য, কৃষক সমবায় ব্যাংকের প্রথম ধারণাটিও উত্তরাঞ্চলে রবীন্দ্রনাথেরই উদ্ভাবন।

ক’টা পত্রিকায় এসেছে এ গল্প? ভদ্রলোক নিজেই বা ক'জনকে বলে বেড়িয়েছেন? 

ছবি: কৃষকদের সাথে মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ। 

কন্যাদায়গ্রস্ত রবীন্দ্রনাথ বলে আরেকটি পরিচয় আছে বিশ্বকবির। নিরুপায় হয়ে একবার নিজ কন্যার অপমৃত্যু কামনা করতে হয়েছিল তাঁকে। ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন নগেন্দ্র নামীয় এক পাষাণের সাথে। ঘরজামাই যখন আদরের মেয়ে মীরাকে দরজা বন্ধ করে মারত, তখন দরজার বাইরে পায়চারি কান্নাকাটি করতেন মহীধর মানুষটি। বিশ্বসাহিত্য যাঁর নিয়ন্ত্রণে, তাঁর হাতে নেই স্বীয় কন্যার অধিকার! নির্যাতন থেকে মীরার মুক্তিতে তাই তার মৃত্যু কামনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এক চিঠিতে উঠে এসেছে এই তথ্য। বলা হয়, 'হৈমন্তী' গল্পটি তাঁর ছোট মেয়েরই দৃশ্যায়ন।

রবীন্দ্রনাথ মানুষ, আমাদের মতো মানুষ। তাঁর জীবনেও ছিল অপার বেদনা, ত্রুটি, অপারগতা। যার সবটুকুকে তিনি পরিণত করেছিলেন লেখনীতে, সাহিত্যে ৷ আমরা যখন ‘জুতা আবিষ্কারে’ হাসি, তখন তাঁর আনন্দই প্রতিধ্বনিত হয়। আমরা যখন ‘সকল দুখের প্রদীপে’ দুঃখ পাই, তখন তাঁর অব্যক্ত আর্তনাদই ডুকরে ওঠে। আবার, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে কৃষকদের ভাগ্য ফেরাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকা মানুষটিও কিন্ত তিনিই। এই শাসক রবীন্দ্রনাথকে এবং পিতা রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকালে বোঝা যায়, মানুষের সাথে মিশে যাওয়া এবং স্বীয় দুঃখভোগকে সৃষ্টিতে উৎসর্গ করার ক্ষমতা তাঁকে আজীবন জিইয়ে রাখবে।

এই রবীন্দ্রই আমাদের। কবিগুরু নন, বিশ্বকবি নন, রক্ত মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথ। ২২শে শ্রাবণ কবির প্রয়াণদিবসে রইলো অতল শ্রদ্ধা।

শাফায়াত স্বচ্ছ 
শিক্ষার্থী 
ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, সৈয়দপুর 

এসবিডি/এবি/

মন্তব্য করুন: