• ঢাকা

  •  রোববার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

মত-অমত

শারদীয় দুর্গোৎসবের ইতিবৃত্ত

সুব্রত কুমার মুখার্জী

 আপডেট: ১৬:০৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

শারদীয় দুর্গোৎসবের ইতিবৃত্ত

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দুর্গাপূজা বা শারদীয় দুর্গোৎসব সবথেকে বড় উৎসব হিসেবে উদযাপন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ ও পৃথিবীর সকল সনতান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব এটি। দুর্গোৎসব কখন, কিভাবে শুরু তা নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ চালু রয়েছে।

সনাতন ধর্মীয়দের প্রধান ধর্মগ্রন্থসমূহ যেমন - পূরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য ও নানা ঐতিহাসিক গল্প থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় সভ্যতায় বিভিন্ন মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। তেমনি আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। পাশাপাশি অনার্য সভ্যতায় প্রধান ছিলেন দেবীরা। ভারতীয় উপমহাদেশে মাতৃরূপে দেবী পূজা পদ্ধতি অতি প্রাচীন।

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠির হাতেই দেবী পূজা প্রচলিত হয়। বিভিন্ন বিশ্বাস ও গ্রন্থে দেখা যায়, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। মহাভারত অনুসারে দুর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। তবে কালী ও দুর্গার মধ্যে রয়েছে নানা অমিল। অনেকে মনে করেন সিন্ধু সভ্যতায় দেবীমাতার, ত্রিমস্ক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে পূজিত হতেন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, শ্রীকৃষ্ণ দেবী দুর্গা পূজার প্রথম প্রবর্তক। দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গাপূজার আয়েজন করেন মহাদেব। ভাগবত পুরান অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করেন। গবেষকদের তথ্যমতে, মূল বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গাপূজার কথা বলা নেই। তবে কৃত্তিবাসী অনুবাদে দুর্গাপূজার কথা বলা হয়েছে।

নবদুর্গা বলতে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ বর্ণনা করা হয়। হিন্দু পুরাণের বর্ণনামতে, এ নয়টি রূপ হলো - শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুস্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী।

ভিন্ন ধর্মীয়গ্রন্থের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের রয়েছে মতভেদ। আবার বৌদ্ধ পন্ডিত পরিব্রাজক হিউয়েন সাংগকে নিয়ে দুর্গাপূজার কাহিনী প্রজলিত রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যার জন্য ৬৩০ সালে তিনি ভারত সফরে আসেন। ৬৩৫ থেকে ৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি হর্যবর্ধনের রাজসভায় ছিলেন। প্রবাস জীবনে তিনি একাধিকবার দস্যুর হাতে পড়েছেন। গঙ্গাপথে বা প্রাচীন গঙ্গারিডিতে তিনি কোনো বৌদ্ধ বিহারে যাওয়ার পথে দস্যুদের হাতে পড়েন। দস্যুরা তাকে বলি দেওয়ার জন্য দেবীর সামনে নিয়ে যায়। অনেকে মনে করেন এ দেবী দুর্গা নয় বদদেবী বা কালী দেবী। দুর্গাপূজায় নরমুণ্ডু দেবার তথ্য পাওয়া যায় না।

ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ১১ থেকে ১২ শতকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে কালীপূজার সাথে দুর্গাপূজা হতো। অনেকে মনে করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল যা পরবর্তী সেন আমলে হিন্দু মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে।

১১শ’ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দুর্গাবন্দনা পাওয়া যায়। বাংলায় ১৪শ’ শতকের পূর্ব দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল কি-না এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বিশেষ করে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা গৃহে স্বাভাবিকভাবে দুর্গাপূজা করতেন।

জাঁকজমকভাবে দুর্গাপূজার শুরু নিয়েও রয়েছে মতভেদ। কতিপয় ঐতিহাসিকদের মতে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আবার কারো কারো মতে ষোড়শ শতকে রাজশাহীর তাহেরপুর এলাকার রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আবার ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। আবার অনেকের তথ্যমতে ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার দুর্গাপূজা শুরু করেন।

১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায়চৌধুরী পরিবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন বলে মত প্রচলিত রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠিতভাবে জানা যায়, ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বর্তমান দুর্গাপূজার পদ্ধতি অর্থাৎ দুর্গার ছেলে মেয়েসহ সপরিবারে পূজা পদ্ধতি চালু করেন। ১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী বর্তমান রংপুরে শারদীয় দূর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃষ্ণদেব দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। অনেকের মতে, লর্ড ক্লাইভের সম্মানে এ দূর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।

প্রাচীন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে দেবী দুর্গার কথা বলা হলেও রাজশাহীর কংসনারায়ণকেই পূজার প্রবর্তক বলে মিথ প্রচলিত আছে। এ মিথ প্রচলনের মূল কারন কংসনারায়ণ দূর্গোৎসব করেছিলেন রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে। সে সময়ে তিনি দুর্গাপূজাতে আট লাখ মুদ্রা খরচ করেছিলেন। কংসনারায়ণের দেখানো পথে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজাবাড়িতে দুর্গোৎসবের মাধ্যমে দুর্গার শাস্ত্রীয় রূপ ছাড়িয়ে চাকচিক্যটা বেশি দেখা দেয়।

১৮শ’ শতকে আধুনিক দুর্গাপূজার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ধরা হয়। বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসায়ী, রাজ দরবারের রাজ কর্মচারীদের মধ্যে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। ১৭৬৭ সালে সাতক্ষীরার কলারোয়ার মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে দুর্গাপূজা হতো বলে প্রচলিত আছে। ১৮০৯ সালে পাটনাতে দুর্গাপূজার জলরং-এর (ওয়াটার কালার) ছবি পাওয়া যায়। সম্রাট আকবরের আমল থেকে ওরিষ্যার রামেশ্বরপুরে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।

বর্তমানে প্রচলিত দুর্গাপূজা দুইভাবে হয়ে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে পরিবারিক কাঠামোতে। যেখানে পূজার শাস্ত্রীয় বিধান, নিয়মনিষ্ঠা অধিক পালন করা হয়। বারোয়ারি বা সার্বজনীনভাবে এলাকাভিত্তিক দূর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যা বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। ১৭৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে সর্বপ্রথম সার্বজনীনভাবে দুর্গাপূজার আয়োজন করে। বারো ইয়ার বা বারো বন্ধুর পূজা নামে পরিচিত এ পূজা একসময় বারোয়ারি নামে পরিচিতি পায়।

১৮৩২ সালে কাসীম বাজারের রাজা হরিনাথ বারোইয়ারের এই পূজাপদ্ধতি কলাকাতায় শুরু করে। পরবর্তীতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে বারোয়ারি পূজা। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মী উৎসাহিনীসভা ভবনীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে, রামধন মিত্র লেন ও সিকদার বাগানে বারোয়ারি পূজা হয়। 

অনেকের মতে, দুর্গোৎসবের মাধ্যমের ভারতের স্বাধীনতাকে অস্তমিত করার উৎসব পালিত হয়েছিল। আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায় ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোসের দুর্গোৎসবে। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে দুর্গাপূজার উৎসবে আমন্ত্রণ জানান। স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কবি নজরুলের আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম কবিতা যার গুরুত্ব অপরিসীম। 

গবেষকদের মতে, ব্রিটিশ শাসনের সময়ে হিন্দু ধনিক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গাপূজা জনপ্রিয় হয়। হিন্দু সমাজের ভিতরে যে শ্রেণিভাগ ছিল তা ঐ সময়ের জন্য সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। দুর্গাপূজা ঐ সময়ের জন্য সকল শ্রেণিকে একত্রিত করার উৎসব হিসেবে পরিণত হয়। 

বাঙ্গালির ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপূজা। ভারতবর্ষ তখন নামেমাত্র মুঘল শাসন। সবে বাংলা মৌখিক আনুগত্যে নবাবী শাসন। মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ মারাঠাদের খাজনা আদায়ের অনুমতি দিলে তা নিয়ে শুরু হলো নবাব আলিবর্দীর সাথে সংঘর্ষ। যে সংঘর্ষকে বলা হতো বর্গী হামলা। এই বর্গীদের নেতা ভাস্কর পন্ডিত ঘাটি করলেন কাটোয়াতে। সেপ্টেম্বর মাসে সে বছর দুর্গাপূজা। বর্ষার ভরা গঙ্গা নদীর সুরক্ষা বলয়ে বর্ধমান রাজার বাড়িতে শুরু হলো দুর্গাপূজা। আলিবর্দী সুযোগের অপেক্ষাতে ছিলেন। তিনি আচমকা মারাঠাদের উপর আক্রমণ করেন। বর্গীরা আক্রমণে পিছু হটে। ভাস্কর পন্ডিত দুর্গামূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে পলায়ন করেন। ভাস্কর পন্ডিতের এই দুর্গাপূজা তার প্রথম ও শেষ হলেও ঐ গ্রামের মহিলারা সেখানে নিয়মিত পূজা আয়োজন করছেন।

বাংলায় বর্তমানে প্রচলিত যে দুর্গামূর্তি দেখা যায় সেখানে সপরিবারে। দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গনেশ এবং বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিক-কে দেখা যায়। বাকুড়া জেলায় দেবী দুর্গার এক বিশেষ মূর্তি পূজিত হয়। সেখানে কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। অঞ্চলভেদে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের মূর্তি পূজিত হয়। 

শারদীয় দুর্গাপূজা সাধারণত আশ্বিন মাসে হয় তবে অনেক সময় তা পরিবর্তন হয়। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত দুর্গোৎসব। তবে দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী আমাবস্যার দিন থেকে। যে দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। বাঙ্গালির দুর্গোৎসবে মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রর গুরুগভ্মীর কন্ঠে ভোরবেলায় চন্ডীপাঠ আলোড়ন তৈরি করে। দেবীপক্ষের সমাপ্তি হয় পূর্ণিমায়। এ পূর্ণিমাটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত। এ দিনে লক্ষ্মীপূজা হয়। তবে অঞ্চলভেদে এ অনুষ্ঠান আরো দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত ছুটি থাকে। বাংলাদেশে বিজয়া দশমীর দিন ছুটি দেয়া হয়।

হিন্দু শাস্ত্রে দুর্গা নামটির বিশেষত্ব রয়েছে। ‘দ’ দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ পাপনাশক ও আ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক আয়োজন দেখা যায়। বিশেষ করে বাগেরহাট জেলায় শিকদারবাড়িতে বৃহৎ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে শারদীয় দুর্গোৎসবে মানুষকে সচেতন ও শিক্ষা দেয়ার জন্য বিশেষ বিশেষ থিমের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যেকটি পূজা মন্ডপে শিক্ষামূলক থিম তৈরি করা হয়। তেমনি বাংলাদেশের বৃহৎ পূজাগুলোতে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবী, বিভিন্ন ঘটনাকে তুলে ধরা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শারদীয় দুর্গোৎসব এমনকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও উদযাপিত হয়। ২০০৬ সালে মহা দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

বিশেষ করে রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত দূর্গোৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা। দেবী পুরাণে কুমারী পূজার কথা বলা হয়েছে। শাস্ত্র বিধানে ১ থেকে ১৬ বছরের অজাতপুস্প সুলনা কুমারীকে পূজার বিধান রয়েছে। সনাতন ধর্মের অন্যতম দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সালে কলকাতার বেলুড় মঠে ৯ জন কুমারী পূজার মাধ্যমে এ পূজার প্রচলন করেন।
  
রামায়ন অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে শরৎকালের দুর্গা উৎসবকে অকালবোধনও বলা হয়। দেবী দুর্গার অনেক রূপ রয়েছে। নবদুর্গা বলতে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ বর্ণনা করা হয়। হিন্দু পুরাণের বর্ণনামতে, এ নয়টি রূপ হলো - শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুস্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী।

শারদীয় দুর্গোৎসবের নয়দিনে দেবী দুর্গার এই নয় রূপের আরাধানা হয়। নবরাত্রির প্রথম দিনে মা শৈলপুত্রী রূপে দেবীর আরাধনা হয়। নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ হলো ব্রহ্মচারিণী। দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিনে এঁর স্বরূপেরই আরাধনা করা হয়। দেবীর মস্তকে অর্ধচন্দ্র থাকে তাই দেবীকে চন্দ্রঘন্টা বলা হয়। তৃতীয়দিনে দেবী চন্দ্রঘন্টা নামে পূজিত হন। ব্রহ্মজ্ঞানী দেবীকে নবরাত্রের চতুর্থদিনে কুস্মান্ডা রূপে পূজা করা হয়। কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ। স্কন্দমাতা হিসাবে পঞ্চমরাত্রে দেবী পূজিত হন। ষষ্ঠদিনে ভক্তদের কাছে ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে কাত্যায়নী পূজিত হন। সপ্তমরাতে কৃষ্ণবর্ণা দেবী কালরাত্রি হিসাবে ভক্তদের সামনে আবির্ভূত হন।  হিমালয়কন্যা ছিলে কৃষ্ণবর্ণের মহাদেবের গঙ্গাজলে স্নান করে তিনি হয়ে উঠেন ফর্সা। অষ্টমরাতে সব পাপ ধুয়ে নেওয়ার জন্য মহা গৌরী রূপে দেবীকে পূজা করা হয়। নবদুর্গার শেষরূপ সিদ্ধিদাত্রী। সকল সিদ্ধিলাভ করার জন্য দেবী দুর্গাকে নবমীতে সিদ্ধিদাত্রী হিসেবে পূজা করা হয়। স্বয়ং মহাদেব দেবী দুর্গাকে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পূজা করেছিলেন। বিশেষ করে বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশে-এ দুর্গাপূজা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালা, হিমাচল প্রদেশ, মহীসুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশে নবরাত্রি পূজা হয়ে থাকে।

বাংলা বারোমাসে দেবী ১২টি রূপে পূজিত হন। বৈশাখ মাসে গন্ধেশ্বরী। জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী রূপে কালিপূজা হয়। আষাঢ় মাসে আম্বুবাচী তিথিতে দেবী কামাখ্যা রূপে পূজিত হন। শ্রাবণ মাসে শাকম্ভরী রূপে। পুরাণ মতে ভাদ্র মাসে মহাদেব ও পার্বতীর মিলন হয়। মহাদেব হলেন পুরুষ ও পার্বতীকে বলা হয় প্রকৃতি। ভাদ্র মাসে পার্বতী রূপে দেবী পূজিত হন। আশ্বিন মাসে মহিষাসুর দমনকারী রূপে দেবী ভক্তের সামনে আসেন। কার্তিক মাসে দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে দেবীকে আরাধনা করা হয়। অগ্রহায়ণ মাসে আদিশক্তির কাত্যায়নী রূপে পূজার প্রচলন পদ্ধতি রয়েছে। পৌষমাসে পৌষকালী রূপে আরাধনা করা হয়। এ সময়ে বাংলার অন্যতম সবজি মুলা দেবীকে নিবেদন করা হয়। তাই অনেকেই এ সময়ের পূজাকে মুলাকালী পূজা বলে থাকেন। মাঘ মাসের কৃষ্ণচতুর্দশীতে রটন্তীকালী পূজো হয়। এ রূপকে আদিশক্তির গৃহশান্তির রক্ষাকারিণী বলা হয়। সঙ্কটনাশিনী রূপে ফাল্গুন মাসে দেবী পূজিত হন। বসন্তের শুরুতে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয় এ কারনে দেবীর সঙ্কটনাশিনী রূপে এ সময়ে পূজা হয়। ধরিত্রীকে শস্যপূর্ণ করার আহ্বানে দেবীকে বাসন্তী রূপে চৈত্র মাসে আরাধনা করা হয়।

হিন্দু শাস্ত্রে দুর্গা নামটির বিশেষত্ব রয়েছে। ‘দ’ দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ পাপনাশক ও আ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। 

শারদীয় দুর্গোৎসবের রূপের নাম মহিষমর্দিনী। অসুর রাজ্যের রাজা মহিষাসুরকে যখন দমন করা যায় তখন দেবীর এ রূপ তাকে দমন করেন। অসুর ভারতের একটি আদিবাসী উপজাতি। ভারতের বিশেষকরে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড আর বিহারে এ উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। হিন্দু বাঙ্গালীরা যখন সর্বোচ্চ উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন করেন সেসময়ই শোক পালন করে আদিবাসি অসুর বংশীয়রা।

এ আদিবাসীদের লোককথা অনুযায়ী, আর্যদের দেবী দুর্গা এ সময়ে মহিষাসুরকে ছলনার মাধ্যমে হত্যা করেন। অসুর আদিবাসীদের লোকগাথা অনুযায়ী এক গৌরবর্ণা নারী তাদের সম্রাটকে হত্যা করেন। তাদের সম্রাট মহিষার ছিলেন অত্যন্ত বলশালী, প্রজাবৎসল রাজা। রাজা মহিষাসুর কোনো নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন না। এরকমই সুযোগ আর্যারা নিয়ে দুর্গাকে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগানো হয়।

আদিবাসী অসুর উপজাতি ষষ্ঠী, সপ্তমীতে শুরু করে শোক পালন। তারা দশমীতে বড় অনুষ্ঠান করেন। পাশাপাশি হিন্দুবাঙ্গালিরা দশমীতে করে থাকে বিজয়া দশমী। শুধুমাত্র লোকগাথায় নয়, প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনে পাওয়া যায় মহিষাসুরকে। গবেষকরা মনে করেন, আর্যদের পূর্ববর্তী ইতিহাস এই অসুর উপজাতি।

কলাবৌ এর উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। তবে কলাবৌ এর পোশাকি নাম নবপত্রিকা। এই নবপত্রিকা বা নয়টি উদ্ভিদ হলো কচু, হরিদ্রা বা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব বা বেল, দাড়িম্ব বা ডালিম, অশোক, মানকচু এবং ধান।

অসুর উপজাতির রয়েছে নিজস্ব ভাষা ‘আসুরি’ ভাষা। অনেক গবেষক মনে করেন, এই আসুরি ভাষা থেকেই বাংলার কথ্য ভাষা বা প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। ১১২০ সালে আসুরিলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। অসুরদের আদি ঈশ্বর মহাদনিয়া বা মহাদেব। মহাদেব শিবকে তারা আদিদেবতা হিসাবে পূজা করে থাকেন। মহিষাসুরমর্দিনী কাহিনীতে দেখা যায়, মহিষাসুর শিবের বরপ্রাপ্ত হন। যার ফলে তাকে যুদ্ধে হারানো যায় না এবং একইসাথে সে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি ধারণ করতে পারেন। অনেক পন্ডিতেরা মনে করেন, ভারতবর্ষের আদি ঈশ্বর রুদ্র বা শিব। মুন্ডাদের দেবতা ‘‘সিং বোঙ্গা” যে বিষ্ণু বা নারায়ন নামে পরিচিত। 

বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব রয়েছে। মধ্যযুগ থেকে রবীন্দ্রনাথের কলমেও জেগে উঠেছে বাঙালির প্রাণের উৎস দুর্গোৎসবের কথা। বর্ষা শেষ হতে শরতের আগমন হয়। তাই হয়ত মানুষের মনে এ শারদীয় দুর্গোৎসবের রয়েছে অনন্য অবদান। ১৯২১ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচার পত্রিকায় কবিগুরুর দুর্গোৎসব নিয়ে দীর্ঘ কবিতা কাঙালিনী প্রকাশিত হয়।  ১৮৯১ সালে সাপ্তাহিক হিতবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছোট গল্প দেনা পাওনা।  একইসাথে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছোটগল্প  সম্পত্তি সমর্পন যেখানেও রয়েছে দুর্গোৎসবের কথা।  রবীন্দ্রনাথ দেবী দুর্গাকে অভিহিত করেছেন আনন্দময়ী হিসাবে। কাজী নজরুল দেবী দুর্গাকে দেখেন ‘রক্তাম্বরধারিণী’ রূপে। মাইকেল মধুসুদন দত্ত তার মেঘনাদবধ কাব্যে দেবী দুর্গার বিসর্জনের বর্ণনা করে কাব্যমে সমাপ্ত করেছেন। বিভূতিভুষণ তার অপু-দুর্গার চোখে তুলে ধরেছেন দুর্গাপূজা। 

সাহিত্যের পাশাপাশি সিনেমায়ও রয়েছে দেবী দুর্গার বন্দনা। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’, ‘নৌকাডুবি’, ‘হীরের আংটি’ আর সত্যজিতের কালোত্তীর্ণ সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ আধুনিককালের দেবী দুর্গাপূজাকে ব্যাপকতা লাভ করিয়েছেন বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ মিলনের উৎসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র হিসেবে।

প্রচলিত দুর্গা প্রতিমা আমরা যেভাবে দেখি সে কাঠামোয় দেবী দুর্গা তার সন্তানদের নিয়ে থাকেন। দুর্গার বাম পাশে দেবী সরস্বতী ও কার্তিক। ডানপাশে দেবী লক্ষ্মী ও গনেশ। এ কাঠামোয় শিবেরও উপস্থিতি দেখা যায়। গনেশের পাশে দেখা যায় কলাবৌ। কলাবৌ এর উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। তবে কলাবৌ এর পোশাকি নাম নবপত্রিকা। এই নবপত্রিকা বা নয়টি উদ্ভিদ হলো কচু, হরিদ্রা বা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব বা বেল, দাড়িম্ব বা ডালিম, অশোক, মানকচু এবং ধান।

পরিশেষে বলা যায় শারদীয় দুর্গোৎসব এখন ধর্মীয় রূপ থেকে পেয়েছে সার্বজনীনতার রূপ।

সুব্রত কুমার মুখার্জী
সাংবাদিক ও এনজিওকর্মী

এসকেএম/এবি/

মন্তব্য করুন: