আইসিটির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন উন্নতির ফলে সমগ্র বিশ্ব আজ বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দূরকে এনেছে চোখের সামনে, অসাধ্যকে করেছে সাধন।
তথ্য-প্রযুক্তিই আগামী দিনে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিবে এবং শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করবে।
একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজ অবস্থান পোক্ত করতে হলে তথ্য-প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। এখনকার সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশ্বের সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল হাতিয়ার। যে জাতি তথ্য প্রযুক্তিতে যত বেশি দক্ষ তাদের সার্বিক অবস্থাও তত বেশি উন্নত। সেই উপলব্ধি থেকে বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া সেক্টরে লাগলেও প্রাথমিক শিক্ষা সেক্টরের ডিজিটাইজেশন চোখে পড়ার মতো।
সমসাময়িক প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। শুরুতেই পাঠ্যবইয়ের কথা বলা যাক। প্রাথমিক শিক্ষায় শিখন ব্যবস্থায় ডিজিটাল মুদ্রণ ব্যবস্থা বই প্রস্তুতকরণে যেসব কালার কম্বিনেশন করা হয়েছে তা অত্যন্ত চমৎকার। কোমলমতি শিশুদের মনে খুব তাড়াতাড়ি এর রেখাপাত ঘটবে। পাশাপাশি ই-বুক প্রণয়ন, শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে পাঠ উপস্থাপন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুগোপযোগী ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।
শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিখন- শেখানো পদ্ধতিতে তথ্যপ্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে কাজে লাগানোর মাধ্যমে কঠিন শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রমকে আনন্দময় করে তোলা হচ্ছে। আজ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম, যা অনেকটাই একঘেয়ে, তা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক আনন্দময় শিক্ষায় রূপান্তর করা হয়েছে। আবার বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় ডিজিটাল হাজিরার প্রবর্তন শুরু হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ বাড়ছে, তেমনি শিক্ষকদের মাঝে সচেতনতা ও কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এটুআই প্রাথমিক শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সাথে কাজ করে যাচ্ছে প্রায় এক দশক যাবত। এটুআই ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নানান কাজে আন্তঃসংযোগ আরও সুদৃঢ় করার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অতিসম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৪) এর আওতায় গত ২৫ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং এটুআই এর মধ্যে আরও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৪) বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এ সকল উদ্যোগের মধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শিক্ষক বাতায়ন, মুক্তপাঠ,ই-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, প্রাথমিক স্তরে গাণিতিক ও পঠন দক্ষতার উন্নয়ন, গাঠণিক মূল্যায়ন ইত্যাদি।
আগামী দিনগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে প্রতিষ্ঠান দু’টির জন্য এই সমঝোতা স্মারক একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
প্রাথমিক শিক্ষকদের গতানুগতিক প্রশিক্ষণের সেই চিরচেনা রূপ পালটে সেখানেও এসেছে প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার। শিক্ষকদের আইসিটি ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য দেশের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটগুলোয় (পিটিআই) ১২ দিনব্যাপী আইসিটি বিষয়ক মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষককে এ বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এ লক্ষ্যে দেশের প্রায় সকল পিটিআইয়ে অত্যাধুনিক আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, উপজেলা শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিসের নানান প্রশাসনিক কাজেও লেগেছে প্রযুক্তির হাওয়া।
অতিসম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষক বদলি প্রক্রিয়া চালু করেছে। যা শিক্ষক বদলির ক্ষেত্রে টিসিভি (টাইম, কস্ট, ভিসিট) কমিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক মায়েদের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে শিশুদের উপবৃত্তির টাকা সরাসরি জমা হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে এই উদ্যোগ বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনেও ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাস্তবায়ন করা হয়েছে ই-মনিটিরিং ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে পরির্দশকরা সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিদর্শন রিপোর্ট তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাঠাতে পারেন। ফলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা প্রদান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়ার সহজতর হয়েছে।
আধুনিক শিক্ষা,জ্ঞান-বিজ্ঞান নির্ভর জাতি গঠনের সকলের প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে প্রধান শক্তিশালী হাতিয়ার হলো আইসিটি। অর্থাৎ একবিংশ শতকের উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে শিক্ষা ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ সমন্বয় ঘটানো ছাড়া আমাদের হাতে অন্য কোনো বিকল্প নেই।
হাসান মারুফ
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
গৌরীপুর,ময়মনসিংহ।
মন্তব্য করুন: