আহ্ সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি
ছেলেবেলাও নেই, সংক্রান্তিও নেই! ব্যাপারটা এমনই হয়ে গেলো। সেই কবে সংক্রান্তির দিনটা উপভোগ করেছিলাম ঠিক মনে নেই। কিন্তু তখন কি যে আনন্দ হতো, সেটা আমার সন্তানকে কিভাবে বোঝাবো। এক জীবনেই কতকিছু যে হারিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে পারছি।
এমনিতেই হিন্দু ধর্মে পার্বণের শেষ নেই। তার ওপর বাঙালি হলে তো হয়েই গেলো। বারো মাসে তেরো পার্বণ কথায় বলে, কিন্তু সেটা আমাদের ক্ষেত্রে খাটে না। আমরা উৎসব আর আনন্দের রাজার জাতি। আনন্দে থাকতে পছন্দ করি বছরভরে। পৌষ এমনিতেই বিশেষ মাস গ্রামবাংলায়। আমাদের এই বাংলায় একসময় ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করতেন। তাদের ধ্যানজ্ঞান ছিল কৃষি। অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হলেই পৌষের গন্ধ যেনো গায়ে লাগতে শুরু করতো।
আমার ছেলেবেলায় যেভাবে পৌষ সংক্রান্তি উপভোগ করেছি তা খুব বেশি সময় আগে না হলেও কম নয়। আশির দশকে আমি কিশোর। বাড়ি বা প্রতিবেশি বড়দের দেখতাম বিভিন্নভাবে পৌষ সংক্রান্তি উদযাপনের প্রস্তুতি নিতো। বাড়ি নারী-পুরুষরা পৌষ সংক্রান্তি ঘিরে যে কৃষ্টি-সংস্কৃতি পালনের রেওয়াজ ছিল তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর কিশোর-যুবাদের প্রস্তুতি থাকতো অন্যরকম।
আমাদের পরিবারে লোকসংখ্যা এমনিতেই কম। তারপর কোনো কিছু করার আগে বাবা-মা'র অনুমতি পাওয়াটা ছিল সবচেয়ে বড় একটা বিষয়। পৌষ সংক্রান্তিতে সবচেয়ে আনন্দের যে বিষয়টি ছিল তা হলো নাড়া দিয়ে ঘর বানানো। যা অনেকের কাছে 'বুড়ির ঘর' বা 'বনের ঘর' নামে পরিচিত। মূলত আমাদের মতো কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা এই ঘর তৈরি করতো। গ্রামীণ জনপদে ঐতিহ্যবাহী এই চিরাচরিত সংস্কৃতি এখনো রয়েছে কি-না তা বলা মুশকিল।
আমরা স্কুল থেকে ফিরেই অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে জমি থেকে ধান কেটে নিলে যে খড় মাঠে পড়ে থাকতো তা কেটে আনতাম। এটা চলতো অন্তত ২০-২৫ দিন। অনেক সময় ধান মারাই করার পর অনেক খড়ের আটি আমরা আলাদা করে জমিয়ে রাখতাম। জঙ্গল থেকে বাঁশ কাটতাম। তারপর এই খর ও বাঁশ দিয়ে বাড়ির পাশে ফাঁকা জমিতে ঘর তৈরি করতাম। ঘরের বেড়াগুলো আমরা দিতে পারলেও চাল তৈরি করতে বড়দের সাহায্য নিতে হতো। এক্ষেত্রে বাড়িতে যারা কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকতেন তারা সাহায্য করতেন। কেউ এই ঘর তৈরি করতেন দোচালা, কেউ চার চালা। তারপর এই ঘর খড় দিয়ে ভর্তি করা হতো। আমাদের গ্রামে কে কত বড় ঘর তৈরি করতে পারে তা নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। তাছাড়া কার ঘরের আগুন কতো উচুতে উঠলো এটাও ছিল একটা আলোচনার বিষয়।
এ তো গেলো ঘর তৈরির কথা। তারপর বনভোজন চলতো এই ঘরে। বাড়ি থেকে চাল-ডাল-সবজি-ডিম এনে এই ঘরে নিজেরাই রান্না করে খেতাম। অনেকেই মাইক বাজিয়ে সারারাত আনন্দ করতো। আর সারারাত চলতো ঘর পাহাড়া দেওয়ার কাজ। কারন, একটা সময় দেখা গেলো অনেকের ঘরে দুষ্টুমি করে কেউ সন্ধ্যারাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাই অনেকে রাতে ঘুমিয়েও কাটাতো এই ঘরে। আমাদের অবশ্য ঘরে থাকা মানা ছিল। যদি ঘরে কেউ আগুন লাগিয়ে দেয় তাহলো তো পুড়ে মরার ভয় থাকতো, এজন্য বাড়ি থেকে নিষিদ্ধ ছিল এটা। তারপর মকর সংক্রান্তির ভোরে সূর্যোদয়ের আগে পুকুরে স্নান সেরে ওই ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে সেই আগুনের উত্তাপে নিজের শরীর গরম করতাম।
স্নান করা নিয়েও ছিল আলসেমি। কিন্তু স্নান তো করতেই হবে। না হলে খোসপাঁচড়া হবে, দুষ কাটা যাবে না, এগুলো ছিল ভীতির ব্যাপার। তাই পুকুরপাড়ে বসে থেকে হঠাৎ ঝাঁপ দিতাম জলে।
এবার আসি পিঠেপুলির কথায়। এখনকার মতো তখন মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলো না। তবুও গ্রামজুড়ে দেখা যেতো কমবেশি প্রত্যেক বাড়িতে তৈরি হতো বিভিন্ন রকমের বাহারি পিঠা। আমরা সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই শুরু করতাম পিঠা খাওয়া। মা, ঠাকুরমা সারারাত ধরে পিঠা তৈরি করতেন। আশেপাশের বাড়িতে গেলেও পিঠা খেতে দিতো।
তখন যে জিনিষটা দেখা যেতো, মানুষের মধ্যে ভাগাভাগিটা কম ছিল। এখন যেমন মানুষের চেয়ে হিন্দু-মুসলিম বেশি; তখন মানুষ বেশি ছিল জাতভেদ কম ছিল। তখন ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে নিম্নশ্রেণির গরীব মানুষ সারাদিন বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে ঘুরে পিঠে নিতে আসতো।
সংক্রান্তির দিন সকালে হতো বাস্তু পুজা (বাস্তু মানে ভিটে বা জায়গা)। বাড়ির বাস্তু দোষ দূর করার জন্য এই পূজা করা হতো।
পৌষ সংক্রান্তির দিন আর যে জিনিষটা হতো। সেটা হলো মেলা। সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসতো। ষাঁঢ়ের লড়াই হতো মেলায়। বাড়ির অনুমতি পেলে মেলা দেখতে যেতাম হেঁটে দূরে কোথাও।
দেশ বা স্থানভেদে পৌষ সংক্রান্তি উদযাপনে বিভিন্ন রেওয়াজ বা প্রথা রয়েছে। সবাই তাদের প্রথা মেনেই এই উৎসব উদযাপন করে থাকে। ধর্মের বিধান যাই হোক, বাঙালির জীবনে পৌষ পার্বণ একটা রসনাময় দিন। #
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সময়বিডি.কম
এসবিডি/এবি/
মন্তব্য করুন: