• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪

মত-অমত

পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি কি, এর তাৎপর্য কি?

অভিরুপ বন্দ্যোপাধায়

 প্রকাশিত: ১৫:০০, ১৫ জানুয়ারি ২০২৩

পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি কি, এর তাৎপর্য কি?

পৌষ সংক্রান্তি কি, এর তাৎপর্য কি?  পৌষ সংক্রান্তি, মকর সংক্রান্তি, তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তি পৌষ মাসের শেষদিনে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে বলে এই সংক্রান্তিকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলা হয়। শাস্ত্রমতে মানুষের এক বছর দেবতাদের একটি দিন-রাতের সমান অর্থাৎ মানুষের উত্তরায়ণের ছয়মাস দেবতাদের একটি দিন ও দক্ষিণায়নের ছয়মাস দেবতাদের একটি রাত।

‘মকরসংক্রান্তি’ শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।

রাত্রে মানুষ যেমন সকল দরজা-জানালা, প্রধান ফটক ইত্যাদি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন, তেমনি দেবতাগণও রাত্রে অর্থাৎ দক্ষিণায়ণে সবকিছু বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় বাহির থেকে প্রবেশ করার সুযোগ নেই, অর্থাৎ দক্ষিণায়ণে দেবলোক পুরোপুরি বন্ধ থাকে। আবার দেবগণের রাত পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় বলে পরবর্তী উদয়ের ব্রহ্মমুহূর্ত থেকে (গোস্বামী মতে) দেবগণের দিবা শুরু হয়।

উক্ত সময়ে স্বর্গবাসী ও দেবলোকের সকলেই নিদ্রা ভঙ্গ হয় এবং নিত্য ভগবৎ সেবামূলক ক্রিয়াদি শুরু হতে থাকে। এই জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান, নামযজ্ঞ, গীতাপাঠ, শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটিকে আনন্দময় করে তোলেন।

স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-

“দিনসংক্রমণে কৃৎস্নং দিনং পুণ্যম।
অর্থাৎ, সংক্রান্তি দিনের বেলা সংক্রমণ ঘটলে সমস্তদিনই পুণ্যকাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোনো ব্রত বা উপবাস করার পূর্বে যেরকম সংযম করে ব্রতাদি পালন করা হয় এবং কীর্তন শুরুর পূর্বে যেমন অধিবাস অনুষ্ঠিত হয় তেমনি উত্তরায়ণকে সামনে রেখে পূর্ববর্তী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-পার্বণ এবং নামযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করে থাকেন। উত্তরায়ণে দেবতাগণ জাগ্রত হওয়ার শুভলগ্নে পুজা-পার্বণের দ্বারা তাঁদের সন্তুষ্টির ক্রমে যাতে দেবধামে পৌছে পরবর্তীতে সেখান থেকে দেবগণের সহায়তায় ভগবৎধামে যাওয়ার সুর্কীতিটুকু অর্জন করা যায়; এই উদ্দেশ্যে দেবতাদের পূজা-পার্বণ করে তাঁদের অশেষ কৃপা লাভ করা।

মানুষ যা করতে পারে না দেবগণ তা অতি সহজে করতে পারেন। তাই উত্তরায়ণ পদার্পণের শুভক্ষণে এবং দেবগণ জাগ্রত হওয়ার পূণ্যলগ্ন ব্রহ্মমুহূর্তে স্নানসমাপন পূর্বক আহ্নিক ক্রিয়াদি শেষে ফুল-তুলসি, সাধ্যমতো প্রসাদি নিবেদন পূর্বক যজ্ঞ, পূজা, প্রার্থনা, অতিথিসেবা ইত্যাদির মাধ্যমে ভগবৎধামে যাওয়ার সুর্কীতিটুকু অর্জন করার চেষ্টা করা হয়। কারণ জীবের প্রকৃত ঠিকানা ভগবৎধাম।

ভগবৎধামে অনন্ত সৌন্দর্য, অনন্ত মাধুর্য, অনন্ত সুখ ভাগ্যবান ভক্তবৃন্দই কেবল আস্বাদন করে থাকেন।

এই সুর্কীতিটুকু অর্জনের মানসে উত্তরায়ণের প্রাক্কালে দেবগণের বিশুদ্ধ ও নির্মলচিত্ত থাকা অবস্থায় কায়মনবাক্যে প্রার্থনার বিধান হয়ত আর্য ঋষিগণ রেখে গেছেন, যাতে সহজে দেবগণের মন বিগলিত হয়ে তাঁদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করা যায়। কারণ দেবগণের নিদ্রার সময় অপেক্ষা জাগ্রত অবস্থায় পূজা, পার্বন ও তাদের উদ্দেশ্যে কর্মাদি করা উত্তম। এসকল কারণেই উত্তরায়ণ সংক্রান্তির গুরুত্ব অত্যাধিক।

অন্যদিকে, মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিশ্ববিখ্যাত বীর, মহাপ্রাজ্ঞ, সর্বত্যাগী ও জিতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ ভীষ্মের মহাপ্রয়াণের স্মৃতির জন্য উত্তরায়ণ সংক্রান্তি আরও মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে। উল্লেখ্য, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবপক্ষের চারজন সেনাপতির মধ্যে তিনিই প্রথম সেনাপতি।

উভয় পক্ষের আঠারদিন যুদ্ধের দশম দিবসে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে পাণ্ডব পক্ষের সেনাপতি অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভীষ্মদেব রথ থেকে মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু তিনি মাটি স্পর্শ না করে আটান্ন দিন তীক্ষ্ণ শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়ণের অপেক্ষা করে পৌষ সংক্রান্তির দিনে যোগবলে দেহত্যাগ করেছেন। শাস্ত্রমতে ভীষ্মদেব মৃত্যুর পরে ভগবদ্ ধামে যাননি।

তিনি ছিলেন ‘দৌ’ মতান্তরে দ্যু নামক অষ্টবসু (আজান দেবতা), যিনি মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপগ্রস্ত হয়ে ইহলোকে মনুষ্য হিসাবে কৃতকর্ম ভোগের জন্য জন্ম নিয়েছিলেন। তাই তাঁর পুনরায় দেবলোকেই যাবার কথা। কারণ তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণায়নের সময় দেবলোকে রাত্রি, সেই সময় সেখানকার সবকিছু বন্ধ থাকে।

ভীষ্ম যদি দক্ষিণায়নে দেহত্যাগ করতেন, তবে তাঁকে তাঁর লোকে প্রবেশ করার জন্য বাইরে প্রতীক্ষা করতে হতো। তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন বলে ভেবে দেখলেন, দক্ষিণায়নে মহাপ্রয়াণ করলে দেবলোকে গিয়ে বাইরে প্রতীক্ষা করার চেয়ে এখানে থেকে উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করাই ভালো।

কারন এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ হবে এবং সৎসঙ্গ হতে থাকবে, যার ফলে সকলেরই মঙ্গল হবে। দেবলোকে একলা প্রতীক্ষা করে কী হবে? এই ভেবে তিনি দক্ষিণায়নে শরীর ত্যাগ না করে উত্তরায়ণে শরীর ত্যাগ করেছিলেন। ভীষ্মদেবের এই মহাপ্রয়াণের স্মৃতির জন্য সনাতণ ধর্মাবলম্বীগণের নিকট উত্তরায়ণ সংক্রান্তি বেশী গুরুত্ব পেয়েছে।

পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোব পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে।

লেখক: অভিরুপ বন্দ্যোপাধায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

এসবিডি/এবি/

মন্তব্য করুন: