ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাস
২০ নভেম্বর থেকে কাতারে শুরু হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের মহারণ। এতে ৩২টি দেশ অংশগ্রহণ করছে। চার বছর অন্তর আয়োজিত হওয়া ফিফা বিশ্বকাপ ১৯৩০ সালে প্রথম উরুগুয়েতে শুরু হয়েছিল।
১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বকাপ হয়নি। কাতারের এবারের বিশ্বকাপ ২২তম বিশ্বকাপ। ব্রাজিল সর্বোচ্চ ৫ বার বিশ্বকাপ জিতেছে। জার্মানি ও ইতালি চারবার করে বিশ্বকাপ জিতেছে।
বিশ্বকাপের বল তৈরি করে জার্মানির ক্রীড়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থা এডিডাস।
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সময় থেকে দুটি ট্রফি এখনো পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল জুলে রিমে ট্রফি। ১৯৭৪ সাল থেকে কাপের নাম হলো ফিফা বিশ্বকাপ (FIFA World Cup)।
ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল বিশ্বকাপ, সকার বিশ্বকাপ, অথবা শুধু বিশ্বকাপ নামেও পরিচিত। একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা যেখানে ফিফা (ফরাসি: FIFA বা Fédération Internationale de Football Association - উচ্চারণ: ফেদেরাসিওঁ অ্যাঁতের্নাসিওনাল্ দ্য ফুৎবল্ আসোসিয়াসিওঁ, অর্থাৎ 'আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা'।
প্রতিযোগিতাটি দুটি ভাগে বিভক্ত, বাছাইপর্ব ও চূড়ান্ত পর্ব। চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন দল খেলবে তা নির্বাচনের জন্য অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে বাছাইপর্বে অংশ নিতে হয়। বর্তমানে মূল বিশ্বকাপের আগের তিন বছর ধরে প্রতিযোগিতার বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতার বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ৩২টি জাতীয় দল চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়।
সকার বিশ্বকাপ ট্রফি:
চ্যাম্পিয়নদের ট্রফির রেপ্লিকা দেওয়া হয়। তাছাড়া তাদের নাম অরিজিনাল ট্রফির তলায় লেখা থাকে। জুলে রিমে ট্রফির পর এই কাপ দেওয়া হয়।
অরিজিনাল কাপটি ডিজাইন করেছিলেন আবেল লাফলিওর। বর্তমানে যে কাপটি ব্যবহার করা হয় তা ডিজাইন করেছেন সিলভিও গাজ্জানিগা।
প্রাক্তন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের নামে প্রথম ট্রফির নাম রাখা হয়েছিল। সোনার প্লেটে রূপার তৈরি এই কাপ ছিল। গ্রিসের জয়ের দেবী নাইকিকে এই কাপ প্রতিনিধিত্ব করতো।
১৯৮৩ সালে জুলে রিমে ট্রফি চুরি হয়ে যায় ও চোরেরা সেটি গলিয়ে ফেলে। ব্রাজিলের পুলিশ পরে এই চোরদের গ্রেপ্তার করে। ১৯৭৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ প্রথম ব্যবহার করা হয়। ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে তৈরি এই কাপ। দুটি মানুষ পৃথিবীকে ধরে আছে তার ছবি কাপে থাকতো।
৬.১৪২ কিলোগ্রাম এই কাপের ওজন। যার মধ্যে ৫ কিলোগ্রামই সোনায় তৈরি।
জুলে রিমে বিশ্বকাপ ট্রফি:
এই ট্রফির প্রথম নাম ছিলো ভিক্টোরিয়া। ১৯৪৬ সালে তখনকার ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমেকে সম্মান জানাতে তার নামে ট্রফির নাম রাখা হয়। এই ট্রফির উচ্চতা ছিলো ৩৫ সেন্টিমিটার, ওজন ছিলো ৩.৮ কিলোগ্রাম।
একাধিকবার এই ট্রফি চুরি হয়। ১৯৭০ সালে ব্রাজিল শেষবারের মতো জুলে রিমে বিশ্বকাপ ট্রফি জেতে। যদিও ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ট্রফি চুরি হয়ে যায়।
ফিফা বিশ্বকাপ:
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের পর ফিফা নতুন ট্রফির জন্য প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। ৭টি দেশের শিল্পীরা এতে অংশ নেয়। পরে সিলভিও গাজ্জানিগার ডিজাইন নির্বাচিত হয়। জিডিএ বার্তনি এটা তৈরি করেন। ৩৬.৮ সেন্টিমিটার উচ্চতা এই ট্রফি ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে তৈরি। পাদদেশ ১৩ সেন্টিমিটার ডায়ামিটার। যে দল এই কাপ জেতে চার বছর তারা এটা রাখতে পারেন। পরে তাদের ট্রফির রেপ্লিকা দেওয়া হয়।
১৯৯১ সাল থেকে ফিফা ফিফা মহিলা বিশ্বকাপ আয়োজন শুরু করেছে। এটিও সাধারণ বিশ্বকাপের মতো চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়।
ইতিহাস:
বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা হয়েছিল ১৮৭২ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে। প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ছিল ১৮৮৪ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশিপ। এ সময়ে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের বাইরে ফুটবল খেলা বলতে গেলে অনুষ্ঠিতই হতো না। সেই শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এটিকে ১৯০০, ১৯০৪ ও ১৯০৬ সালের অলিম্পিকে প্রদর্শনী খেলা হিসেবে রাখা হয়। তবে এর জন্য কোনো পুরস্কার বরাদ্দ ছিল না।
১৯০৮ সালের অলিম্পিকে ফুটবল প্রথম আনুষ্ঠানিক খেলার মর্যাদা পায়। এফএ’র পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রতিযোগিতা ছিল অপেশাদার খেলোয়াড়দের জন্য। এটিকে প্রতিযোগিতার চেয়ে প্রদর্শনী হিসেবেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হতো। ১৯০৮ ও ১৯১২ দু’টি অলিম্পিকেই গ্রেট ব্রিটেন (যাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল ইংল্যান্ড জাতীয় অপেশাদার ফুটবল দল) জয়লাভ করে।
১৯০৪ সালে ফিফা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঠিক পরেই, ১৯০৬ সালে ফিফা সুইজারল্যান্ডে অলিম্পিকের আদল থেকে ভিন্ন একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক ফুটবলের বয়স তখনো অনেক কম এবং হয়তো একারণেই ফিফার ইতিহাসে এই প্রতিযোগিতাকে ব্যর্থ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
অলিম্পিকে অপেশাদার দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলার পাশাপাশি স্যার থমাস লিপটন ১৯০৯ সালে তুরিনে স্যার থমাস লিপটন ট্রফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এটি ছিল বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ক্লাবের (জাতীয় দল নয়) মধ্যে একটি চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা। এসব দলের প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, এজন্য এই প্রতিযোগিতাকে অনেকে প্রথম বিশ্বকাপ বলেন।
এতে ইতালি, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড-সহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা পেশাদার দল অংশ নেয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন এই প্রতিযোগিতার সাথে জড়িত থাকতে ও পেশাদার দল পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়।
ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য লিপটন পশ্চিম অকল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানান, যা ছিল ডারহাম কাউন্টির একটি অপেশাদার দল। পশ্চিম অকল্যান্ড এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় এবং পরবর্তীতে ১৯১১ সালের প্রতিযোগিতায় শিরোপা ধরে রাখতে সমর্থ হয়। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুসারে তাদেরকে চিরতরে ট্রফিটি দিয়ে দেওয়া হয়।
১৯১৪ সালে ফিফা অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠিত ফুটবল প্রতিযোগিতাকে 'অপেশাদার বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় এবং এই প্রতিযোগিতা পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এর ফলে ১৯২০ সালের গ্রীষ্ম অলিম্পিকে বিশ্বের প্রথম আন্তমহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয় মিশর ও তেরটি ইউরোপীয়ান দল। এতে বেলজিয়াম স্বর্ণপদক জিতে নেয়।
উরুগুয়ে ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালের অলিম্পিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ লাভ করে। ১৯২৮ সালে ফিফা অলিম্পিকের বাইরে আলাদাভাবে নিজস্ব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩০ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ পা দেওয়া দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে (১৯২৪ সাল থেকে ফিফার পেশাদার যুগ শুরু করে) ফিফা তাদের ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হিসেবে নির্বাচন করে।
নভেম্বর ২০, ২০২২
এসবিডি/এবি/
মন্তব্য করুন: